এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ইংরেজি এবং আইসিটির ধাক্কা লেগেছে এবারের এইচএসসির সার্বিক পাসের হারে। ইংরেজিতে দেশের দশ শিক্ষা বোর্ডে ফেল করেছে ২৪ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। অপরদিকে আইসিটিতে ফেল করেছে ১০ শতাংশ। দুই বিষয়েই ফেলের হার গত বছরের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় ২১ শতাংশ এবং মানবিক বিভাগে প্রায় ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলের ওপর।

বৃহস্পতিবার ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এইচএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের আলিম এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসিসহ (বিএম) মোট ১০ বোর্ডের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ পাসের হার গত বছরের চেয়ে ২ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। গত ৬ বছরের মধ্যেও এবারের পাসের হার সর্বনিু। শুধু পাসই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এবার সর্বমোট ২৯ হাজার ২৬২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত বছর পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ কমেছে ৮ হাজার ৭০৭টি। তবে এবার ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাসের হার প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। নইলে পাসের হার আরও কমপক্ষে ৩ শতাংশ নেমে যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার পেছনে পরীক্ষার হলে এবং খাতা মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’কে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘এতদিন সংখ্যাগত উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমরা গুণগত উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা ক্লাস নেয়া ও ভালোভাবে পরীক্ষা গ্রহণের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ঠিকভাবে যেন পরীক্ষার খাতা দেখা হয়, সেদিকে নজর দিচ্ছি। কাজেই যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। আমরা কাউকে নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলি না, কমাতেও বলি না। সঠিক মূল্যায়ন করতে আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করেছি।’

শিক্ষাবিদদের অনেকেই এবারের পরীক্ষায় পাসের হার হ্রাসের পেছনে শিক্ষামন্ত্রীর মতোই কথা বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে গুণগত মান আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। পাশাপাশি উত্তরপত্র মূল্যায়নে স্বচ্ছতা, আন্তরিকতা ও জবাবদিহিতা বেড়েছে। এবার প্রশ্ন ফাঁসও হয়নি। পরীক্ষার হলেও কিছুটা কড়াকড়ি ছিল। এসবের কারণেই হয়তো পাসের হার কিছুটা কমেছে। তবে এতে আমরা অখুশি নই। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে ভর্তি হওয়া অনেককে দেখেছি অষ্টম-নবম শ্রেণীর দক্ষতা নিয়ে পাস করে এসেছে। সেখানে কড়াকড়ির কারণে যদি ভালো দক্ষতা নিয়ে আসে, সেটা প্রকারান্তরে দেশেরই লাভ হবে। নইলে আমাদের চাকরির বাজারে বিদেশিদের দখল আরও বেড়ে যাবে।

অবশ্য ফল বিশ্লেষণে পাসের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর একটি হচ্ছে, বিজ্ঞানে পাসের হার কমে যাওয়া। এ বছর বিজ্ঞান, মানবিক এবং বিজনেস স্টাডিজ- এ তিন বিভাগে বিষয়ভিত্তিক পাসের হার কম। তবে সাধারণত বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার সবসময় বেশি থাকে। বিজ্ঞান বিভাগের পাসের হার সার্বিক পাসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু এবার এতে প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। মানবিক বিভাগেও ফেলের হার তুলনামূলক বেশি। এতে প্রায় ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

এবার পাসের হার কমে যাওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক খারাপ ফল। এবার সর্বমোট ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৭ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এরমধ্যে পাস করেছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ জন। ৪ লাখ ২৯ হাজার ৯৫৬ ছাত্রছাত্রী ফেল করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের এবং সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান বা কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা. জিয়াউল হকও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এ বোর্ডে গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি- ফরিদপুর, রাজবাড়ী এবং জামালপুর জেলার পাসের হার কম। এর মধ্যে জামালপুর জেলায় ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. মনজুরুল ইসলাম বলেন, প্রায় সারা দেশেই ইংরেজির পাঠদানে বেহাল দশা বিরাজ করছে। হালে আইসিটি বিষয়টিও এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এসব বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক আছেন। এছাড়া পদার্থ, রসায়নের মতো বিজ্ঞানের বিষয়েও একই অবস্থা। তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে কোচিং-টিউশন এবং নোট-গাইড। ক্লাসে উপযুক্ত পাঠদানের ঘাটতি আছে। শিক্ষার্থীরা মূল বই পড়ে না। দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে উল্লিখিত বিষয়ে উন্নতি ঘটাতে না পারলে পাসের হার ভবিষ্যতে যেমন আরও কমতে থাকবে, তেমনি দক্ষ গ্র্যাজুয়েটও তৈরি হবে না। তাই সরকারকে এসব দিকে নজর দিতে হবে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফলাফলের সার-সংক্ষেপ তুলে দেয়া হয়। মূলত তখনই ফল প্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর দুপুর ১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ফল প্রকাশের ঘোষণা দেন। এর কিছুক্ষণ পর থেকে শিক্ষার্থীরা কলেজ, মাদ্রাসায় গিয়ে ফল জানতে পেরেছে। এছাড়া অনলাইন এবং এসএমএসেও শিক্ষার্থীরা ফল জেনেছে।

বৃহস্পতিবার এইচএসসির সঙ্গে মাদ্রাসার আলিম এবং কারিগরি বোর্ডের এইচএসসি (ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা) ফলও প্রকাশ করা হয়। এবার শুধু এইচএসসিতে পাসের হার ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৫৫৬২ শিক্ষার্থী। অপরদিকে মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডসহ দশ বোর্ডে মোট পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দশ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ শিক্ষার্থী।

বিভিন্ন বোর্ডের মধ্যে পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী হচ্ছে- ঢাকায় পাসের হার ৬৬.১৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ ১২৯৩৮ জন। রাজশাহীতে পাসের হার ৬৬.৫১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪১৩৮ জন। কুমিল্লায় পাসের হার ৬৫.৪২ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪৪ জন। যশোরে পাসের হার ৬০.৪০ শতাংশ, ২০৮৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। চট্টগ্রামে পাস ৬২.৭৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৬১৩ জন। বরিশালে পাস ৭০.৫৫ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৭০ জন। সিলেটে পাস ৬২.১১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৭৩ জন। দিনাজপুরে পাস ৬০.২১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২২৯৭ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৮.৬৭ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১২৪৪ জন। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৭৫.৫০ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪৫৬ জন। এছাড়া ঢাকা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা-ইন বিজনেস স্টাডিজ পরীক্ষা নেয়া হয়। এতে পাসের হার ৮৭.৮২ শতাংশ। এতে কেউ জিপিএ-৫ পায়নি।

ইংরেজি ও আইসিটি ঝড়েই কুপোকাত : এবারের পরীক্ষার সাতটি বিষয়ের পাসের হার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলায় সারা দেশে পাশের হার গত বছরের চেয়ে বেশি। গত বছর ৯৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছিল। এবার সেই হার ৯৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু পাসের হার কমেছে ইংরেজি ও আইসিটিতে। গত বছর আইসিটিতে পাস করেছিল প্রায় ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এবার এ হার ৯০ শতাংশ। ইংরেজিতে গত বছর ফেলের পরিমাণ ছিল ২২ শতাংশ। এবার প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এ বিষয়ে ফেল করেছে।

তিন বিভাগেই পাসের হার নিুমুখী : বিজ্ঞান, মানবিক এবং বিজনেস স্টাডিজের শিক্ষার্থীদের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিষয়ভিত্তিক পাসের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে। বিজ্ঞান বিভাগে রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞানে গত বছর পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৯৪.৪০ এবং ৮৮.৮৮ শতাংশ। এ বছর এ দুই বিষয়ে পাসের হার যথাক্রমে ৯০.১২ এবং ৮৩.৯৮ শতাংশ। মানবিকে পৌরনীতিতে গত বছর পাস করেছে ৯৩.৬১ শতাংশ। এবার সেই হার ৯৩.৪১ শতাংশ। বিজনেস স্টাডিজের হিসাববিজ্ঞানে পাসের হার গত বছর ছিল ৮৭.৪৯ শতাংশ, এবার পাস করেছে ৮৫.৮৬ শতাংশ।

৬ বছরে সর্বনিম্ন ফল : গত ৬ বছরের মধ্যে এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে। গত বছর পাসের হার ছিল ৬৮.৯১ শতাংশ। ২০১৬ সালে পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১৫ সালে পাসের হার ছিল ৬৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৮.৩৩ এবং ২০১৩ সালে ছিল ৭৪.৩০ শতাংশ। অপরদিকে রোববার প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, এইচএসসি, আলিম ও এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় মোট পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

চারটির তিন সূচকই নিুগামী : ভালো ফলের সূচক হিসেবে চারটি দিক ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে- পাসের হার, মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শতভাগ ও শূন্য পাস করানো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার এর তিনটিই নিুমুখী। এ বছর ১০ বোর্ডে মোট পাসের হার গত বছরের চেয়ে কম। কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অপরদিকে গত বছর শতভাগ পাস করা কলেজ ও মাদ্রাসা ছিল ৫৩২টি, এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৪০০টি। শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান অবশ্য কমেছে। গত বছর ছিল ৭২টি, এবার কমে হয়েছে ৫৫টি। এ শেষ সূচক শুধু ইতিবাচক।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version