এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণের মান ও পরিমাণ কমে যাওয়ার আলোচিত ঘটনা পরস্পরবিরোধী নানামুখী প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ১ বছর বিলম্বে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হয়ে পড়ায় ভল্টে স্বর্ণ মজুদের স্বচ্ছতা নিয়েও এখন নানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে- এটি কারা, কেন এতদিন গোপন রেখেছিল। আর তদন্ত প্রতিবেদন যদি সত্যি হয়, তাহলে এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করা খুবই জরুরি।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই এতবড় ঘটনাটি বেমালুম চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন অবশ্য অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, এটি বড় কোনো ঘটনাই নয়। স্বর্ণের পরিমাণ বা মান নিয়ে কোনো কারচুপি হয়নি। যা হয়েছে তা করণিক ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণের পরিমাণ ও মান যাচাই নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অস্বীকার করা সম্ভব না হলে কাউকে না কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল- বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা তিন কেজি ওজনের চাকতিকে স্বর্ণ হিসেবে প্রমাণের পর এ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তাই এখন স্বর্ণের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে অনেক কিছুই বিতর্কের মুখে পড়বে।
এদিকে তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে অনেকে আশঙ্কা করছেন, বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা উচ্চমানের স্বর্ণ রহস্যজনকভাবে নিম্নমানের স্বর্ণ দেখিয়ে জমা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২১ ও ২২ ক্যারেটের শত শত কেজি স্বর্ণ ১৮ ক্যারেট হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্বর্ণের ওজনেও বড় গরমিল ধরা পড়েছে। বিশেষ করে সোয়া তিন কেজি (৮০ শতাংশ) পরিমাণ স্বর্ণের চাকতি ভিন্ন ধাতুতে রূপান্তরের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হলেও সংশ্লিষ্টরা প্রায় ১ বছর ধরে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি এক রকম ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল। তবে আশার কথা, বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারপ্রধানের নির্দেশে এর চুলচেরা বিশ্লেষণসহ কোথাও কোনো ব্যত্যয় হয়ে থাকলে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বুধবার বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট অনিরাপদ হলে তা রিজার্ভ চুরির চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা। তবে বিষয়টি নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। ফলে সঠিক বিষয়টি বের করে আনতে হলে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে এর তদন্ত করতে হবে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিষয়টি যাচাইয়ের সময় দু’পক্ষকেই সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। আর তৃতীয়পক্ষের তদন্তে যারা মিথ্যা প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, যে কোনো ক্যারেটের স্বর্ণ ভল্টে রাখা যায়। এতে কোনো সমস্যা নেই। মূলত আদালতের নির্দেশে যা রাখতে বলবেন তা রাখতে আমরা বাধ্য। তিনি দাবি করেন, ভল্টে নিরাপত্তার জন্য ৭০ জন পুলিশ বরাদ্দ। ৩২ জন পুলিশ নিয়মিত থাকেন। ৪২টি সিসি ক্যামেরায় যে মহানিরাপত্তা বলয় তাতে স্বর্ণে হেরফের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০১৭ সালের শুরুতে অনিয়ম উদ্ঘাটন হলেও কেন এতদিনে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হল না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা যখন প্রতিবেদন দেয় তখনই এ বিষয়ে লিখিত জবাব দেয়া হয়, এমনকি তারা মেনেও নেয়। এখন মিডিয়ায় আসার কারণে তোলপাড় শুরু হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদন অনুযায়ী ২১ ও ২২ ক্যারেট মানের সব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে এলে ১৮ ক্যারেট হয়ে যায়, এটি কেন? এর জবাবে তিনি বলেন, মান নির্ধারক মেশিনে তারতম্য হতে পারে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক কষ্টিপাথর বা সনাতনী পদ্ধতিতে স্বর্ণের মান নির্ধারণ করে। তারা করেছে ডিজিটাল মেশিনে।
এসব বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দার তৎকালীন ডিজি এবং বর্তমানে শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেটের দায়িত্বে থাকা ড. মইনুল খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে আমি ওই দফতরের দায়িত্বেও নেই। তাই কোনো মন্তব্য করা সমীচীন নয়।’
এছাড়া শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক যুগ্ম কমিশনার সফিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটির দু’জন সদস্য দাবি করেন, শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত শতভাগ সঠিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই ভল্টের মজুদ পরীক্ষা করা হয়েছে। স্বর্ণের মানে পার্থক্য ধরা পড়লে মেশিন ছাড়াও সনাতনী পদ্ধতি অর্থাৎ কষ্টিপাথরেও যৌথভাবে যাছাই করা হয়। প্রতিটি পরীক্ষার ফলাফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জিএমসহ ভল্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর রয়েছে। ফলে এটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গুরুতর এসব অনিয়ম ১ বছর আগে উদ্ঘাটিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। বিপরীতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরও চুপ ছিল। রহস্যজনক কারণে কোনো পক্ষই বিষয়টি প্রকাশ যেমন করেনি, তেমনি এ ঘটনার জন্য দায়দায়িত্ব নির্ধারণেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। যে কারণে জনমনে এখন নানা প্রশ্ন ও সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উন্নতমানের সোয়া তিন কেজি স্বর্ণের চোরাচালানের দায়ে আটক ব্যক্তিকে ২০১৬ সালে ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫ এর বিচারক জরিমানাসহ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণে কাস্টমস কর্তৃক আটক কালো প্রলেপযুক্ত চাকতি ও একটি রিং উন্নতমানের স্বর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হয়। রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত আসামি আবুল মনসুর সিকদারের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫বি-এর ১(বি) ধারায় আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ দণ্ড দেয়া হয়েছে।
মামলার নথি অনুযায়ী আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘৩ দশমিক ৩ কেজি স্বর্ণের গোলা আমি দুবাই থেকে এনেছি। আমি দুবাইতে ব্যবসা করি। এয়ারপোর্টে কাস্টমস স্বর্ণের গোলাটি আটক করেছে।’ এরপর আদালতের নির্দেশানুযায়ী কাস্টম হাউস ঢাকার গুদাম কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট জব্দ স্বর্ণের চাকতি এবং রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে আসেন। ভল্ট কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে স্বর্ণের মান ও ওজন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৮০ শতাংশ স্বর্ণ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এ সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র দেন।
অথচ শুল্ক গোয়েন্দার তদন্ত টিম ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জিএম এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উক্ত চাকতি এবং রিং প্রথমে মেশিন এবং পরে কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করে সোয়া তিন কেজির দুটি চাকতিতে ৮০ শতাংশের স্থলে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২০ ক্যারেট) এবং ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ (০৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট) স্বর্ণ পাওয়া গেছে মর্মে উল্লেখ করে। এ সংক্রান্ত পরীক্ষার ফলাফল শিটে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে নগণ্য পরিমাণ স্বর্ণ মিললেও উক্ত চাকতি ও রিং আদৌ স্বর্ণ নির্মিত নয় অর্থাৎ সংকর ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি। স্বর্ণের পরিবর্তে অন্য ধাতু পাওয়ায় এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা।
এদিকে এর রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশজুড়ে এখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। রীতিমতো টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, এ চাকতির ৪০ শতাংশ স্বর্ণকে করণিকের ভুলে ৮০ শতাংশ সোনা হিসেবে জমা রাখা হয়েছে। কিন্তু এ দাবি অবাস্তব বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, প্রচলিত আইনে ৫০ শতাংশের নিচে স্বর্ণ থাকলে সেটি সোনা হিসেবে বিবেচিত নয়। আর তা হলে এমন পণ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখারও কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আদালতের সাক্ষ্য-প্রমাণে আটক পণ্য ৮০ শতাংশ স্বর্ণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। চোরাচালানের দায়ে আটক ব্যক্তিকেও ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তার দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংক গা বাঁচাতে এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। কারণ শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তকালে প্রাপ্ত ফলাফলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়া কেন মজুদ স্বর্ণের ওজন কমে গেল এবং ২১ ও ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ ১৮ ক্যারেট দেখানো হয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
শুল্ক গোয়েন্দার তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মইনুল খান ২০১৬ সালের মার্চে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানের নির্দেশে ভল্টের স্বর্ণ মজুদের গরমিল অনুসন্ধানে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কয়েক দফা পরীক্ষা করে। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উদ্ঘাটন হয়, মজুদ স্বর্ণে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে। পরিমাণ এবং মানের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বিশেষ করে ৩ দশমিক ৩ কেজির একটি চালানে স্বর্ণের বদলে অন্য ধাতুর চাকতি ও রিং পাওয়া গেছে, যা ২০১৫ সালে ৮০ শতাংশ স্বর্ণ হিসেবে প্রত্যয়ন করে অস্থায়ী ভল্টে জমা রাখা হয়।
তদন্তকালে আরও জানা যায়, একমাত্র স্বর্ণপিণ্ড ছাড়া সব স্বর্ণালঙ্কারই ১৮ ক্যারেট হিসেবে মজুদ রাখা হয়েছে। ওজনেও রয়েছে অনেক তারতম্য। তাৎক্ষণিকভাবে কমিটির সদস্যরা এসব অনিয়ম শুল্ক গোয়েন্দার সাবেক ডিজিকে অবহিত করেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানায়, তদন্তে পাওয়া এসব নেতিবাচক কোনো তথ্য যেন কেউ জানতে না পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে কড়া নির্দেশনা দেন ওই সময় এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দায় থাকা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। কিন্তু কী কারণে তারা গোপন করেছিলেন তা আজও রহস্যঘেরা।
এদিকে ভল্টের স্বর্ণের পরিমাণ ও মান নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু এ পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনিয়ম জেনেও বছরব্যাপী চুপ ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা। স্পর্শকাতর এসব অনিয়মের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও অবহিত করা হয়নি।
রিজার্ভ চুরির মতো ভল্টের স্বর্ণে অনিয়ম নিয়ে এ লুকোচুরিকে রহস্যজনক উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে নিজেই দায়ী সেখানে এখন তাদের নিজস্ব কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করলে প্রকৃত দায়ীদের চিহ্নিত করা যাবে না। প্রকৃত রহস্যও উদ্ঘাটিত হবে না। এজন্য জাতীয় স্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে এসব অনিয়ম তদন্ত করা উচিত। তদন্তে যারাই দায়ী বলে চিহ্নিত হবেন তাদের আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা সব স্বর্ণই বিদেশ থেকে চোরাইপথে আমদানি করা। চোরাচালানিরা ঝুঁকি নিয়ে নিম্নমানের স্বর্ণ আনবে- এটা অবাস্তব। এজন্য এসব বিদেশি স্বর্ণে খাদ কম এবং অধিকাংশই উচ্চমানের ২১ ও ২২ ক্যারেটের অলঙ্কার হিসেবে আটক হয়। অনেক স্বর্ণের মান ছিল ২২ ক্যারেটের চেয়েও বেশি। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে এসব অলঙ্কার মাত্র ১৮ ক্যারেট হিসেবে মজুদ করা রহস্যজনক। এছাড়া সোয়া তিন কেজির চাকতিতে ৪০ শতাংশ সোনা থাকার দাবিও অবান্তর।
১৭ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণে কোনো হেরফের হয়নি। যেভাবে রাখা হয়েছিল, সেভাবেই আছে। স্বর্ণ মাপের ক্ষেত্রে ভুল যন্ত্র ব্যবহার ও মাপের পর এর পরিমাণ লেখার ক্ষেত্রে করণিক ভুলে এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তদন্তের সময়ই তারা এ বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। করণিক ভুলের ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, স্বর্ণকার ওই সময় পরীক্ষা করে বলেছিলেন, চাকতিতে ৪০ শতাংশ স্বর্ণ আছে। কিন্তু পরে প্রতিবেদন লেখার সময় ভুলে করণিক বাংলায় লেখা ৪০ কে ইংরেজিতে ৮০ মনে করে লিখে ফেলেন। এ দাবি হাস্যকর বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, চোরাচালানের দায়ে কাস্টমস এবং কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স গত কয়েক বছরে প্রায় ১ হাজার ৫৯৯ কেজি স্বর্ণবার এবং অলঙ্কার আটক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখে। এসব স্বর্ণ যথাযথভাবে মজুদ আছে কিনা তা কেস টু কেস পরিদর্শনের জন্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যানের নির্দেশে একটি কমিটি করা হয়। গঠিত আট সদস্যের কমিটিকে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
কমিটির কার্যপরিধি ছিল তিনটি। এর মধ্যে গত ৩ বছরে বড় ও স্পর্শকাতর মামলার বিপরীতে আটক স্বর্ণবার ও অলঙ্কার সরেজমিন পরিদর্শন করা, এসব স্বর্ণের সংরক্ষণ পদ্ধতি ও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো ইস্যু আছে কিনা তা যাছাই করা এবং পরিদর্শনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুসরণ করে জমাকৃত স্বর্ণালঙ্কার ও স্বর্ণবারের সঠিকতা যাচাই করা। কমিটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জিএমসহ ভল্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দৈবচয়ন ভিত্তিতে নমুনা সংগ্রহ করে এর মান ও ওজন যাচাই করে। এরপর তদন্তের ফলাফল সুপারিশসহ শুল্ক গোয়েন্দার তৎকালীন ডিজি ড. মইনুল খানের কাছে জমা দেয়। তিনি ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রতিবেদনটি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠান।
এনবিআর চেয়ারম্যান প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের কাছে পাঠিয়ে দেন। শুল্ক গোয়েন্দার ডিজি মইনুল খান স্বাক্ষরিত পত্রে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ক) ভল্টে ভিজিআর নম্বর ১১১০/১৪ মূলে জমা দেয়া মোট তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত স্বর্ণের চাকতি এবং একটি কালো প্রলেপযুক্ত স্বর্ণের রিংয়ের পরিবর্তে যথাক্রমে অন্য ধাতুর চাকতি এবং রিং পাওয়া গেছে।
স্বর্ণ হিসেবে জমা হলেও প্রকৃত যাচাই-বাছাইয়ে স্বর্ণ পাওয়া যায়নি। এতে সরকারের ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে। খ) অন্যান্য ক্ষেত্রে স্বর্ণালঙ্কারের ক্যারেটে এবং ওজনের তারতম্য পরিলক্ষিত হওয়ায় সরকারের এক কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৬ টাকা আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা। গ) উভয় ক্ষেত্রে প্রায় তিন কোটি টাকার স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারে গরমিল পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, তদন্ত কমিটি ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শন ও সরেজমিন স্বর্ণ যাচাই কার্যক্রম শুরু করে। অস্থায়ী ভল্টে রক্ষিত সব স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার পরীক্ষা করে। ২২৭টি মামলার বিপরীতে ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ পরীক্ষা করা হয়। সরেজমিন পরীক্ষার জন্য তদন্ত কমিটি দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। এর মধ্যে স্বর্ণের মান বা ক্যারেট পরীক্ষার জন্য স্বর্ণের মান নির্ধারক মেশিন ব্যবহার করে দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরীক্ষা করা হয়।
ওজন পরীক্ষার জন্য ভল্টে রাখা স্কেল ব্যবহার করা হয়। এসব পরীক্ষা সম্পন্ন হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে। তবে তদন্ত কমিটি সূত্র দাবি করেছে, শুধু মেশিন নয়, মানে তারতম্য হওয়ায় কষ্টিপাথরেও মান যাচাই করা হয়। উভয় পরীক্ষায় একই ফলাফল হলেই তা কমিটি বিবেচনায় আনে।
এদিকে ৮০ শতাংশের সোনার চাকতির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট কালো প্রলেপযুক্ত স্বর্ণের চাকতি এবং কালো প্রলেপযুক্ত রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়ে আসেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক চাকতি ও রিংয়ে ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে এবং একটি প্রত্যয়নপত্র দেয়। শুল্ক গোয়েন্দার পরিদর্শন দল সংশ্লিষ্ট সবার উপস্থিতিতে চাকতি পরীক্ষা করে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২০ ক্যারেট) এবং ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট) স্বর্ণ পায়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী চাকতি ও রিং আদৌ স্বর্ণ নির্মিত নয়, সংকর ধাতুর সমন্বয়ে তৈরি। স্বর্ণের পরিবর্তে অন্য ধাতু পাওয়ায় ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পরিদর্শনে জমা নেয়ার সময় স্বর্ণালঙ্কারের ক্যারেটে এবং পরিদর্শনকালে প্রাপ্ত ক্যারেটের মধ্যে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বর্ণ গ্রহণের সময় দেয়া সনদে বিশুদ্ধতা ৮০ শতাংশ (১৮ ক্যারেট) দেয়া হয়। কিন্তু পরিদর্শনে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৯১ দশমিক ৭৪ শতাংশ (২২ ক্যারেট) পাওয়া যায়। উচ্চ ক্যারেট সম্পন্ন স্বর্ণালঙ্কারকে নিম্ন ক্যারেটের স্বর্ণালঙ্কার হিসেবে গ্রহণ করায় এসব স্বর্ণ নিলামে বা অন্য উপায়ে বিক্রি করা হলে সরকার অতিরিক্ত ক্যারেটের বিপরীতে প্রযোজ্য অর্থ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আশঙ্কা ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক স্বর্ণালঙ্কার, স্বর্ণবার, স্বর্ণ কাটপিস জমা নেয়ার পর দেয়া সনদে উল্লেখিত ওজনের চেয়ে প্রায় ক্ষেত্রেই পরিদর্শনে ওজন বেশি পাওয়া যায়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী উচ্চ ক্যারেট ও অধিক ওজনের স্বর্ণালঙ্কার নিম্ন ক্যারেট এবং নিম্ন ওজনের স্বর্ণালঙ্কার হিসেবে জমা প্রদান এবং গ্রহণ করায় সরকারের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা সৃৃষ্টি হয়েছিল।
২৪ জুলাই ডিসি সম্মেলন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ব্যাংকে স্বর্ণ রয়েছে ৯৬৩ কেজি, এর মধ্যে তিন কেজি দূষিত। এটা কোনো সমস্যা নয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে। সেগুলো অনর্থক (ইউজলেস)। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণ গরমিল ইস্যুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভূমিকার সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ নিয়ে এনবিআরের কোনো কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়। সোনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকই সিদ্ধান্ত নেবে।’
এছাড়া ১৮ জুলাই বুধবার অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ভল্টে রাখা স্বর্ণ ঠিক আছে এবং ঘরেই আছে। ভল্টে রাখা স্বর্ণ নিয়ে অনিয়মের খবর যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতিতেই এ সংকট। ওই ঘটনাকে মোটেও ছোট করে দেখা হচ্ছে না। কারণ সামান্য ফাঁক দিয়েও বড় সমস্যা হয়ে যেতে পারে। পর্যালোচনা করে কারও বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন মাঝে মধ্যে ধারণাগত ফারাক হতে পারে। এটি নতুন কিছু নয়। ভল্টের স্বর্ণ সঠিক আছে দাবি করে তিনি বলেন, যে পরিমাণের কথা বলা হয়েছে ৯৬৩ কেজি, তা মোটেই ঠিক নয়। সব স্বর্ণ ঠিক আছে, ঘরেই আছে। একথা যে সঠিক তা জনগণ বা যে কোনো সংস্থা চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে দেখে আসতে পারে। তিনি বলেন, ৪০ ও ৮০ ক্যারেটের সমস্যা হয়েছে, এটি ক্লারিক্যাল এরর। লেখার মধ্যে ইংরেজি বাংলা মিশ্রণ হয়ে গেছে।