এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : শুধু বড় বড় ঋণ জালিয়াতি নয়, কৃষিঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও অবিশ্বাস্যরকম জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে জনতা ব্যাংকে। ভূমিহীনকে জমির মালিক বানিয়ে নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।

এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত দলিল, পর্চা, ওয়ারিশ সনদ সবই ছিল জাল। এমনকি স্বাক্ষর এবং সিলও নকল। এ ছাড়া যার নামে ঋণ সৃষ্টি করা হয়, সে নিজেই জানেন না, তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এর বাইরে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল নমুনা ভিত্তিতে ১০০টি ঋণ পরীক্ষা করে।

এর মধ্যে ৪৮টি ভুয়া হিসেবে শনাক্ত করা হয়। অবিশ্বাস্য এসব ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে ব্যাংকটির রংপুরের পীরগাছার চৌধুরাণী শাখায়। এ ছাড়া চাঁদপুর কো-অপারেটিভসহ আরও কয়েকটি শাখায় বেশকিছু ঋণ অনিয়মের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক স্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সুপারিশকারীর যোগসাজশে এবং দালাল চক্রের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ তছরুপ করা হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতি রংপুর অঞ্চলের অন্যান্য শাখায় হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় এ রকম ভয়াবহ অনেক ঋণ অনিয়ম বেরিয়ে আসছে, এটা উদ্বেগজনক। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। এটি বন্ধ করতে হলে সরকারকে দ্রুত একটি বিশেষায়িত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংক বিশ্লেষকদের অনেকে জানিয়েছেন, সরকারি এ ব্যাংকটির দায়-দেনা, ঋণ জালিয়াতি ও খেলাপি ঋণের দায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছাড়াও পরিচালনা পর্ষদের। কোনোভাবেই পর্ষদ সদস্যরা এ দায় এড়াতে পারবেন না।

বিশেষ করে এ পর্যন্ত যেসব বড় ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়েছে তার পেছনে ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালকদের যোগসূত্রতা রয়েছে। খাতা-কলমে প্রমাণ করা না গেলেও এটিই বাস্তবতা। তবে শক্তভাবে তদন্ত হলে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করা সম্ভব।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, পীরগাছার চৌধুরাণী শাখায় স্থানীয় অভিযোগকারীর একটি অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শন চালায়।

এরপর নমুনা ভিত্তিতে মাত্র ১০০টি ঋণ পরীক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। এর মধ্যে ৪৮টি ঋণ ভুয়া হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এ ধরনের ভুয়া ঋণ শাখায় আরও আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভুয়া ঋণ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে যে ধরনের অনিয়ম-জালিয়াতি করা হয়, সেগুলো হল- গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র না নিয়েই ঋণ দেয়া, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রে ঋণ প্রদান, দলিল, পর্চা, ওয়ারিশ সনদ সবই ছিল। এমনকি স্বাক্ষর এবং সিলও নকল।

ভূমিহীনকে জমির মালিক বানিয়ে নামে-বেনামে ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের দরিদ্র নিরীহ মানুষের কাছ থেকে কৌশলে ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করে তাদের নামে ঋণ সৃষ্টি করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের দুর্বলতা ও ইন্টারনাল অডিটের অদক্ষতার সুযোগে দিনের পর দিন এ ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ব্যাংকে একটি চক্র থাকে। তারাই এসব অপকর্ম করে। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে আরও স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও দেখায় যায়, জনতা ব্যাংকের চাঁদপুর কো-অপারেটিভ শাখায় কৃষিঋণ বিতরণে গুরুতর অনিয়ম ও জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। শাখা ব্যবস্থাপকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কৃষিঋণ বিতরণের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ দৈন্যদশার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধারণা। অনিয়মের সারসংক্ষেপে দেখা যায়, একই ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে একাধিক নামে ঋণ দেয়া হয়েছে। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ প্রদান, ভুয়া পৌর কর রসিদ ব্যবহার করে ঋণ প্রদান, একই দিনে ঋণ আবেদন, জরিপ এবং ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ডেবিট ভাউচারের মাধ্যমে নগদ টাকায় ঋণ বিতরণ করার ঘটনাও ঘটে।

এদিকে জনতা ব্যাংকের আরও দুটি শাখায় সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিংয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ শাখা ও ফরিদপুর কর্পোরেট শাখায় সান্ধ্যকালীন ব্যাংকিং পরিচালনা করেছে জনতা ব্যাংক।

যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমোদন ছিল না। যদিও পরে অনুমোদন চেয়ে আবেদন পাঠানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত, এর আগে জনতা ব্যাংকের দুটি শাখায় হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় ১১টি প্রতিষ্ঠান এ জালিয়াতি করে। এর মধ্যে জনতা ভবন কর্পোরেট শাখায় ৬৫৫ কোটি এবং স্থানীয় কার্যালয় শাখায় ২৬৬ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়।

এমনকি খেলাপি থাকাবস্থায় এ তালিকা থেকে ফের নতুন ঋণ দেয়া হয়। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কাই করা হয়নি। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত জামানতও নেই।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version