এশিয়ান বাংল ডেস্ক : আরেকটি শোকগাঁথা দৃশ্যায়নের ভয় ঘিরে ধরেছিল। রোভম্যান পাওয়েলের দুর্বিনীত ব্যাটে ঘনীভূত হচ্ছিল শঙ্কার মেঘ। ফিরে ফিরে আসছিল আগের ম্যাচের হৃদয় ভাঙার টাটকা স্মৃতি। তবে সব দ্বিধা, সংশয় আর ভয়কে উড়িয়ে বাংলাদেশ এবার রচনা করল বিজয় কাব্য। শেষ ম্যাচের দারুণ জয়ে ধরা দিল বহু কাঙ্ক্ষিত সিরিজ জয়।

শেষ ওয়ানডেতে সেন্ট কিটসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৮ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের সিরিজ জিতে নিয়েছে ২-১ ব্যবধানে।

৯ বছর পর দেশের বাইরে দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। সবশেষ জিতেছিল ২০০৯ সালের অগাস্টে জিম্বাবুয়েতে। তার আগে সেবছরই জুলাইয়ে সিরিজ জয় এসেছিল ক্যারিবিয়ানে। সব মিলিয়ে এটি দেশের বাইরে বাংলাদেশের পঞ্চম সিরিজ জয়।

অধিনায়কত্বের ১৪তম সিরিজেও জয়ের স্বাদ পেলেন না জেসন হোল্ডার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবশেষ সিরিজ জিতেছিল ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষেই।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট ওয়ার্নার পার্কে শনিবার তামিম ইকবালের রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ করেছিল ৩০১ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের এটি প্রথম তিনশ রানের স্কোর। রান তাড়ায় পাওয়েলের খুনে ইনিংস ক্যারিবিয়ানদের আশা দেখিয়েছিল জয়ের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থমকে গেছে তারা ২৮৩ রানে।
৪১ বলে ৭৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন পাওয়েল। কিন্তু শেষ দুই ওভারে রুবেল হোসেন ও মুস্তাফিজুর রহমান যন্ত্রণায় পুড়তে দেননি দলকে।

জয়ের ভিত রচনা হয়েছে যদিও তামিমের ব্যাটে। প্রথম ম্যাচের মতোই উপহার দিয়েছেন দারুণ এক সেঞ্চুরি। গড়েছেন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দেশের বাইরে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে একাধিক সেঞ্চুরির কীর্তি।

এরপর ঝড় তুলেছেন মাহমুদউল্লাহ। ছয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে দারুণ এক ইনিংস খেলেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা।

যদিও ওপেনিংয়ে চিত্র পাল্টায়নি। তামিম যথারীতি আস্থার প্রতিমূর্তি। কিন্তু এনামুল হক সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ শেষ ম্যাচেও।

আগের ম্যাচে অতি আগ্রাসী খেলে বিপদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এনামুল। এ দিন ছিলেন পুরো উল্টো চেহারায়। ঘুম পাড়ানি ব্যাটিংয়ে বাড়িয়েছেন নিজের ও দলের চাপ। শেষ পর্যন্ত পুষিয়েও দিতে পারেননি মন্থর শুরুটা। উইকেট বিলিয়ে এসেছেন ৩১ বলে ১০ রান করে।

সেখান থেকে দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব সেই তামিম ও সাকিবের। দুজন সেটি করেছেন দারুণভাবে। দ্বিতীয় উইকেটে ৮১ রানের জুটি গড়েছেন ৯৬ বলে।

এই সিরিজে আগের দুই ম্যাচে দুজনের জুটিতে এসেছে ২০৭ ও ৯১ রান। গত ১০ ইনিংসে দুজনের জুটিতে সেঞ্চুরি হয়েছে তিনবার, পঞ্চাশ পেরিয়েছে আরও ৫ বার।

তবে আগের দু্ই ম্যাচের মতো এদিন পঞ্চাশ ছাড়াতে পারেননি সাকিব। ৩৭ রানে ফিরেছেন অ্যাশলি নার্সকে স্লগ সুইপ খেলে। নার্সের বলেই পরে বাজে শটে বোল্ড হয়েছেন মুশফিক।

তামিম এগিয়ে গেছেন প্রায় একই গতিতে। ইনিংসের মাঝপথে থমকে যাননি। বাজে বলকে যেমন বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছেন, এক-দুই করে রান বাড়িয়েছেন নিয়মিত। নব্বইয়েও খেলেছেন শট, ছক্কা মেরেছেন দেবেন্দ্র বিশুকে।

মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে তামিমের ৪৮ রানের জুটি এসেছে ৪৬ বলে। সেঞ্চুরির পর পরই রান বাড়াতে গিয়ে আউট হন তামিম। ফিরেছেন ১২৪ বলে ১০৩ করে।
এরপরই বড় চমক। ছয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামেন অধিনায়ক মাশরাফি। দলকে তিনশর পথে নিয়ে যায় এই চমক জাগানিয়া পদক্ষেপটিই।

দারুণ সব শটে মাশরাফি বদলে দেন ইনিংসের গতি। মাহমুদউল্লাহও হয়ে ওঠেন আত্মবিশ্বাসী। দুজন ৫৩ রানের জুটি গড়েন ৭ ওভারে।

চারটি চার ও ১ ছক্কায় মাশরাফি ফেরেন ২৪ বলে ৩৬ রান করে। শেষ দিকের দাবি মিটিয়ে ৪৯ বলে ৬৭ রানে অপরাজিত থেকে যান মাহমুদউল্লাহ। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ৯৬ রান।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান তাড়ার শুরুটা খারাপ ছিল না। আগের দুই ম্যাচে ধীরগতিতে শুরু করলেও গেইল এদিন ছিলেন আগ্রাসী। তবে এভিন লুইস ছিলেন ব্যর্থতার বৃত্তেই। বলে ব্যাট ছোঁয়াতেই ধুঁকছিলেন। গেইলের সৌজন্যে তবু ১০ ওভারে ৫৩ রান ওঠে উদ্বোধনী জুটিতে।

সিরিজে টানা তৃতীয়বার দলকে প্রথম উইকেট এনে দন মাশরাফি। টানা তৃতীয় ম্যাচে ফেরান লুইসকে (৩৩ বলে ১৩)।

দ্বিতীয় জুটিতেও ঠিক একই চিত্র। এক পাশে দারুণ সব শট খেলেছেন গেইল। স্টেডিয়ামের ছাদে বল ফেলেছেন একবার। একবার পাঠিয়েছেন মাঠের বাইরে। অন্যপাশে হোপ এগোচ্ছিলেন খুঁড়িয়ে। ৫২ রানের জুটিতে হোপের রান ৩২ বলে ১৪!

ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকা গেইলকে থামান রুবেল হোসেন। ৬ চার ও ৫ ছক্কায় ৬৬ বলে ৭২ করে ক্যাচ দেন লং অনে।

অর্ধশত রানের জুটি হয়েছে তৃতীয় উইকেটেও। হোপ ও শিমরন হেটমায়ারের জুটি ৬৭ রানের। আগের ম্যাচে অসাধারণ সেঞ্চুরি করা হেটমায়ারকে ৩০ রানে বোল্ড করে দেন মিরাজ।

হোপ আউট হতে পারতেন আরও আগেই। ৩৬ রানে মিরাজের বলে লং অফে তার ক্যাচ ছাড়েন রুবেল।
দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে মাশরাফি ফেরান ৬৪ রান করা হোপকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আশার সমাপ্তিও তাতেই দেখছিলেন অনেকে। কিন্তু রোভম্যান পাওয়েল তখনও দেখছিলেন স্বপ্ন!
দুর্দান্ত সব শটে ম্যাচ জমিয়ে দেন পাওয়েল। প্রথম ৫ ওভারে ১০ রান দিয়েছিলেন যে মুস্তাফিজ, তার পরের ৩ ওভার থেকে আসে পাওয়েলের তাণ্ডবে ৩৮ রান!

শেষ ৩ ওভারে ৪০ রানের সমীকরণকে তখন অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। পাওয়েল চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মুস্তাফিজ গুছিয়ে নেন নিজেকে। ৪৯তম ওভারে দুর্দান্ত বোলিংয়ে কেবল ৬টি সিঙ্গেল দেন রুবেল। শেষ ওভারের প্রথম বলে মুস্তাফিজ ছক্কা হজম করলেও পরের ৫ বলে দেন ৩ রান।

দুঃস্বপ্নের টেস্ট সিরিজ, আগের ম্যাচের বিষাদকে পেছনে ফেলে সিরিজ জয়ের উল্লাসে মেতে উঠলেন মাশরাফিরা। ধারাভাষ্য কক্ষে তখন ড্যারেন গঙ্গা বলছেন, “ক্যারিবিয়ানে বাংলাদেশের স্মরণীয় সিরিজ জয়।”

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩০১/৬ (তামিম ১০৩, এনামুল ১০, সাকিব ৩৭, মুশফিক ১২, মাহমুদউল্লাহ ৬৭*, মাশরাফি ৩৬, সাব্বির ১২, মোসাদ্দেক ১১*; কটরেল ১/৫৯, হোল্ডার ২/৫৫, বিশু ১/৪২, পল ০/৭৭, নার্স ২/৫৩, গেইল ০/১৪)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৫০ ওভারে ২৮৩/৬ (গেইল ৭৩, লুইস ১৩, হোপ ৬৪, হেটমায়ার ৩০, কাইরান পাওয়েল ৪, রোভম্যান পাওয়েল ৭৪*, হোল্ডার ৯, নার্স ৫*; মাশরাফি ২/৬৩, মিরাজ ১/৪৫, মুস্তাফিজ ১/৬৩, মোসাদ্দেক ০/১০, মাহমুদউল্লাহ ০/২০, রুবেল ১/৩৪, সাকিব ০/৪৫)।

ফল: বাংলাদেশ ১৮ রানে জয়ী, সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-১ ব্যবধানে জয়ী, ম্যান অব দা ম্যাচ: তামিম ইকবাল, ম্যান অব দা সিরিজ: তামিম ইকবাল

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version