এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে যাবে না বলে মত দিয়েছেন দলটির তৃণমূল নেতারা। তারা বলেছেন, জামায়াতকে জোটে না রাখার বিষয়ে চিন্তভাবনা করতে। তাদের বক্তব্য আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারপর জাতীয় নির্বাচন। এজন্য কঠোর আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত রয়েছে তৃণমূল। বিগত বিভিন্ন আন্দোলন শুধু ঢাকার ব্যর্থতার কারণে বিফল হয়েছে জানিয়ে তৃণমূল নেতারা আরও বলেন, আগামী দিনের আন্দোলনে ঢাকা মহানগর নেতাদের মাঠে থাকতে হবে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে জোটে না রাখার বিষয়টি ভাবতেও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দেন তারা। বিএনপি চেয়ারপারসনের শুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে শুক্রবার এক বৈঠকে এসব মতামত দেন দলটির তৃণমূল নেতারা। আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে চার বিভাগের সাংগঠনিক জেলা নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজশাহী ও রংপুর এবং বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিএনপির দশটি সাংগঠনিক বিভাগের মধ্যে বাকি ছয়টি সাংগঠনিক বিভাগের নেতাদের নিয়ে আজ বৈঠক করবেন নীতিনির্ধারকরা। সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা এবং বেলা ৩টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর সাংগঠনিক বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে শুক্রবারের বৈঠকে আরও ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ও বেলাল আহমেদ। তৃণমূল নেতাদের মধ্যে জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য রাখেন। তবে যে জেলার সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বক্তব্য রাখেননি সেই জেলার সিনিয়র সভাপতি কিংবা সাংগঠনিক সম্পাদক বক্তব্য দেন। শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বৈঠকে চার বিভাগের ৭৩ জন নেতা বক্তব্য দিয়েছেন।

তৃণমূল নেতারা বক্তব্যের শুরুতে নিজ জেলার সাংগঠনিক চিত্র তুলে ধরেন। জেলা-উপজেলা কমিটির বর্তমান অবস্থান, গ্রুপিং-কোন্দল, নিষ্ক্রিয় নেতাদের অবস্থান, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা, আহত-নিহতদের পরিসংখ্যান ছাড়াও সংগঠনকে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তারা।

সূত্র জানায়, বৈঠকে রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুলকুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে কোনো নির্বাচন হবে না। ম্যাডামের মুক্তির দাবিতে যে ধরনের আন্দোলন হচ্ছে তা দুঃখজনক। তার মুক্তির দাবিতে আরও কঠোর আন্দোলন দিতে হবে। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, শুনেছি জামায়াতে ইসলামীর কারণে বাম দল, ড. কামাল হোসেন, বি চৌধুরীসহ আরও কয়েকটি দল বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করতে রাজি হচ্ছে না। তাহলে জামায়াতকে বাদ দিয়ে ঐক্য করা উচিত। কারণ জনগণ এখন জাতীয় ঐক্য চান।

জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গে বৈঠকে আরও একাধিক নেতা বলেন, জামায়াতকে জোটে না রাখার বিষয়টি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাদের ছাড়াই বিএনপি জয়লাভ করেছে। সিলেটে জামায়াত প্রার্থী তাদের সারা দেশের নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচার চালিয়েও জামানত হারিয়েছেন। সিলেটে জামায়াতের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে নেতারা বলেন, বিএনপি নেতাদের অনুরোধ সত্ত্বেও তারা তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করেনি। জোটের স্বার্থকে বড় করে না দেখে কেন সিলেটে বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে তা কিন্তু আমাদের অজানা নয়। তাই তাদের ব্যাপারে ভাবার সময় এসেছে।

মেহেরপুর জেলা সভাপতি মাসুদ অরুন বলেন, ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। আগামীতে হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, সমাবেশের মতো কর্মসূচি দিতে হবে। বাগেরহাট জেলার সভাপতি আবদুস সালাম বলেন, অঙ্গ সংগঠনে বিতর্কিত কমিটি দেয়া হচ্ছে। যেখানে আওয়ামী লীগের লোকজন স্থান পাচ্ছেন। জেলা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি দেয়া উচিত। খুলনা জেলা সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে কি রকম নির্বাচন হতে পারে তা বিগত সিটি নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখতে পাই। অতএব শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সাতক্ষীরা জেলার সাধারণ সম্পাদক তরিকুল হাসান বলেন, সাতক্ষীরায় জামায়াত সক্রিয় নয়। কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের পাইনি। এমনকি এ জেলার স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াত বিএনপিকে ভোট দেয়নি।

রাজশাহী বিভাগের একজন নেতা বলেন, রাজশাহী সিটি নির্বাচনে আমাদের ঐক্য ছিল না। দলীয় প্রার্থীকে হারানোর জন্য কেউ কেউ তৎপর ছিলেন। যে কারণে ভোট শুরুর পর থেকে ক্ষমতাসীনরা কেন্দ্র দখল করে নিলেও তা প্রতিরোধ করতে পারেনি বিএনপি। একই বিভাগের আরেক নেতা বলেন, বিএনপি যতই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করুক না কেন সরকার আমাদের শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না। এখনও অনেক জেলায় নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে বসতে পারছেন না। অনেক নেতাকর্মী এখনও মামলা-হামলার ভয়ে এলাকাছাড়া। তাই এ ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে টলানো যাবে না। এজন্য দরকার ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলন। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই কঠোর কর্মসূচি প্রত্যাশা করেন তিনি। বগুড়া জেলার একজন নেতা বলেন, আন্দোলন সফল করার জন্য আগে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

বরিশাল বিভাগের এক নেতা বলেন, আইনি প্রক্রিয়া ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে না। এজন্য কঠোর আন্দোলনে যেতে হবে। রংপুর বিভাগের এক নেতা বলেন, খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো জাতীয় নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। এজন্য আগামী দিনে তার মুক্তির এক দফা আন্দোলন হবে। তিনি মুক্তি পেয়ে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এসব নির্বাচনে সরকারের মুখোশ জনগণের কাছে প্রকাশ পাচ্ছে।

খুলনা বিভাগের এক নেতা বৈঠকে বলেন, সরকার র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের হত্যা-গুম-নির্যাতন করবে আর আমরা চুপ করে থাকব তা হবে না। এবার জীবনের ঝুঁকি নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রয়োজনে সব কেন্দ্রীয় নেতা স্বেচ্ছায় কারাবরণ করব।

রংপুর বিভাগের আরেক নেতা বলেন, নির্বাচন মুখ্য নয়, এখন খালেদা জিয়ার মুক্তিই দলের মুখ্য বিষয়। এখন স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচন হয় না। নির্বাচন হয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে ধানের শীষের। তবে আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থানীয় নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক। এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপক ভোট কারচুপির বিষয়ে দেশি-বিদেশিরা দেখছেন, জানছেন। তবে এখন বিএনপির মুখ্য বিষয় জাতীয় নির্বাচন নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি। আর এজন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই।

বরিশালের আরেক নেতা বলেন, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আন্দোলন সফল হবেই। এজন্য সবাইকে দোষারোপের রাজনীতি বাদ দিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ তিনি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version