এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সেই আগের অবস্থা রাজধানীর সড়কে। আগে যাওয়া নিয়ে বাসের রেষারেষি, মাঝখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা, যত্রতত্র থামানো, চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোন ব্যবহার- সবই চলছে। ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেও ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় বাস রাস্তায় দেখা গেছে। অপরদিকে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে পথচারী পারাপারের প্রবণতাও আছে আগের মতোই।
উল্টোপথে বা ট্রাফিক সিগন্যাল ভেঙে গাড়ি চালানোর ঘটনাও থেমে নেই। অথচ ৫ দিন আগে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে ছিল, তখন রাজধানীজুড়ে ছিল ভিন্ন চিত্র। নিয়ম মানার প্রবণতা তৈরি করেছিল শিক্ষার্থীরা। তারা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার পর সড়কে সেই আগের বিশৃঙ্খলাই ফিরে আসছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় হাইকোর্টের মোড়ে দেখা যায়, সিগন্যাল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারটি বাসের মধ্যে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিআরটিসিরই দুটি বাসের মধ্যে আগে যাওয়া নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়। এ নিয়ে দুই বাসের চালকদের মধ্যে তর্কও হয়।
এ সময় পেছনে থাকা অন্য বাসগুলো বিকট শব্দে হর্ন বাজাতে থাকে। শিক্ষা ভবনমুখী সড়কের আইল্যান্ডে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে একজন সার্জেন্ট দুটি বাসের রেষারেষির এ দৃশ্য দেখিয়ে বলেন, এভাবেই দুই বাসের প্রতিযোগিতা ও ঘষাঘষিতে প্রথমে হাত হারায় কলেজছাত্র রাজিব। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ফার্মগেট, পল্টন, কুড়িলসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা যায় আগের মতোই রেষারেষি করে বাস চলছে। বেশি যাত্রী পেতে একটি বাস আরেকটি বাসের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিও করছে। পুলিশের সামনেই ভাঙাচোরা বাসও চলাচল করছে। শুধু তা-ই নয়, সিটিং সার্ভিসের নামে যেসব গাড়ি চলে সেগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে।
এসব দেখে হতাশার কথা জানান সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সড়ক নিরাপত্তাকর্মী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ। তারা বলেন, শিশুদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন সবার মনে ধাক্কা দিয়েছে। আন্দোলন চলাকালে সবার চেতনায় শানিত ভাব লক্ষ করা যায়, কিন্তু কয়েক দিনেই যেন তা ভোঁতা হয়ে যেতে শুরু করেছে।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একেবারেই হতাশ নন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। সমাজচিন্তক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুদের আন্দোলনে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লাভ হয়েছে। সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে, তারা যে জেগে আছে, সে বার্তা। এদেশ নিয়ে বড়দের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছে তারা। বাচ্চারা বড়দের কাজ করে ক্লাসে ফিরে গেছে। এখন বড়দের প্রত্যয় নিয়ে বাচ্চাদের চিন্তা ধার করে বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে দিন দিন আগের পরিস্থিতি ফিরছে- এমন মন্তব্য আমি করব না। কেননা চালকদের আগের চেয়ে সচেতন মনে হচ্ছে। আগের মতো পাগলাটে প্রতিযোগিতা নেই। তবে যেটুকু বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে, সেটা বাড়তে না দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি মালিকরা অতিমুনাফার চিন্তা বাদ দিলে আর শ্রমিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে পরিবহন খাতে সমস্যা একসময় দূর হবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিশুদের মুখে উঠে আসা দাবিগুলো এদেশের গণমানুষেরই দাবি। তারা শুধু দাবি তুলেই ক্ষান্ত হয়নি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে আইন বাস্তবায়ন করতে হয়। শিশুরা তাদের স্বপ্নের কথা জানিয়ে দিয়ে গেছে। জাতি ও দেশের প্রতি তাদের আস্থা ও শ্রদ্ধা অটুট রাখতে এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কী করতে হবে, সেটা সরকার জানে।’
সড়কে আগের সেই চিত্র ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে হাইকোর্ট মোড়ে কর্মরত পুলিশের এসআই মেহেদী ও কুড়িলে কর্মরত এএসআই আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ফিটনেস সনদ থাকলে এসব গাড়ি আমরা জব্দ করতে পারি না। তবে বিভিন্ন ত্র“টির কারণে মামলা দিচ্ছি। আসলে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে সকলের সচেতনতা দরকার।’
আলাপকালে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিবহন খাতে নানা নৈরাজ্যের জন্য বিআরটিএর অনিয়ম ও দুর্নীতি অনেকটা দায়ী। রাজধানীর তিনটি স্পটে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা লক্কড়ঝক্কড় বাস দেখিয়ে বলেন, এসব বাস কীভাবে ফিটনেস সনদ পেল। কোনো বাসের পেছনের সিগন্যাল লাইট নেই, আবার কোনোটির সামনের লাইট নেই। প্রায় সব বাসেই নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বেশি আসন বসানো হয়েছে। অনেক গাড়ির সিটও ভালো নয়। কিছু গাড়ির ইঞ্জিনও ভালো নয়; প্রায়শ রাস্তায় নষ্ট হচ্ছে। অথচ ফিটনেস সনদ থাকায় এসব গাড়ি আমরা জব্দ করতে পারছি না।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ‘মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী প্রতি বছর একবার গাড়ি পরীক্ষা করে ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। বাকি দিনগুলো গাড়ি ফিট রাখা মালিক ও চালকের দায়িত্ব। তবে আমরা সারা বছরই ৫-৬টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করে থাকি। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে পুলিশেরও দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা উচিত।’
বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও রুট পারমিটসহ অন্যান্য কাগজপত্র পরীক্ষা চলছে। তাই আগের চেয়ে যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার হার দ্বিগুণ বেড়েছে। পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বাড়াতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিআরটিএ বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে।
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘আন্দোলনের পরপরই ট্রাফিক সপ্তাহে মামলা, ডাম্পিং আর জরিমানার ঘটনা বেশি ঘটছে। আন্দোলনের আগে পরিবহন খাতে যে বিশৃঙ্খলা ছিল, তা এখনও আছে। পরিবহন খাতের উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা আনতে পরিকল্পিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ দরকার।’
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পরিবহন দুর্ঘটনা কমাতে বৃহস্পতিবার থেকে চালককে চুক্তিতে বাস চালাতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বেশিরভাগ বাস ওই সিদ্ধান্ত মেনে চলেনি। এ কারণে ৫টি কোম্পানির সমিতির সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
এদিকে সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য পথচারীও কম দায়ী নন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, নানা পদক্ষেপের পরও ঝুঁকি নিয়ে চলছেন যাত্রীরা। বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, ১০ গজ দূরে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও হাতে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। কোথাও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরও এমন কাজ করতে দেখা গেছে। অনেক স্থানে দৌড়ে বাসে উঠছেন যাত্রীরা। বিপরীত দিকে বাসের হেলপাররাও রাস্তার পাশে না থামিয়ে সড়কের ভেতরে রাখছেন গাড়ি। সেখানে যাত্রী তুলছেন। চলন্ত অবস্থায় যাত্রী টেনে তুলতেও দেখা যাচ্ছে। চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বলতেও দেখা গেছে চালকদের।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পথিকৃৎ চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, চালক, মালিক, পথচারী যার ব্যাপারেই বলেন না কেন, অনেক অনিয়ম আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। এটা দূর হতে সময় লাগবে। তবে শিশুরা ওই মজ্জায় আঘাত করে গেছে। চেতনা কিছুটা ফিরেছে। বাকিরা আইন প্রয়োগ করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে পথচারীকে জরিমানার আওতায় আনতে হবে। বাকিদের ব্যাপারে আইন তো আছেই। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন কলেজ শিক্ষক আকলিমা বেগম। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় দেখেছি, একজন মানুষ জেব্রা ক্রসিংয়ে নামলেই গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের দেশেও চালকদের প্রশিক্ষণে এই বিষয়টা বলতে হবে যে, সবার আগে মানুষ।