এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত ১৪টি ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য কুঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।

এসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা প্রভিশন বাবদ বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হয়েছে। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন মিলে এ ব্যাংকগুলোর প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার তহবিল আটকে রয়েছে। এসব অর্থ থেকে ব্যাংকগুলোর কোনো আয় আসছে না। উল্টো এসব অর্থের ব্যবস্থাপনায় অর্থ খরচ হচ্ছে।

এ খাতে স্থগিত সুদ বাবদ রয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। যেগুলো ব্যাংক আয় খাতে নিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পর্যালোচনা পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখা প্রভিশন ও স্থগিত সুদের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রতিবেদনে ১৪ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকের খেলাপির হার কম হলেও পরিমাণে তাদের খেলাপি ঋণ বেশি। তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার খুবই উদ্বেগজনক। তাদের খেলাপি পরিমাণে কম হলেও শতকরা হিসাবে ৫৫ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। বাকি ৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের উপরে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, কোনো ব্যাংকের ৫ শতাংশের উপরে খেলাপি ঋণ থাকাটাই ঝুঁকিপূর্ণ। এ হার ৩ শতাংশের মধ্যে থাকাটা স্বাভাবিক। সেখানে ১৪ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের এ হার ব্যাংকগুলোর ঘোষিত। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সব সময়ই এ ঋণ কম দেখাতে অভ্যস্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বরাবরই খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। ফলে খেলাপি ঋণের এ হার প্রকৃত অর্থে আরও বেশি হবে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে মনিটরিং করছে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি তাদের বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। বেসরকারি খাতের মধ্যে ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ (বিসিবি) আরও দুটি ব্যাংক তালিকায় রয়েছে।

এছাড়া বিদেশি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানও (এনবিপি) এ তালিকায় রয়েছে। কথা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, জাল-জালিয়াতির কারণেই ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। খেলাপির প্রবণতা থেকে ব্যাংকিং খাতকে উদ্ধার করতে হলে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। বেহাত হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে হবে।

তিনি বলেন, খেলাপি ঋণের হার বেশি হলে বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে দেশি ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিদেশি ব্যাংক এলসি গ্যারান্টির ক্ষেত্রে বাড়তি চার্জ করে। এতে ব্যবসায় খরচ বেড়ে যায়।

প্রতিবেদন বলছে, সোনালী ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিয়মিত ঋণ ২১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। যেসব ঋণ খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে চলে গেছে সেগুলো একটি ‘বিশেষ হিসাবে’ রাখা হয়। এ ঋণের পরিমাণ ৯০১ কোটি টাকা। এগুলো যে কোনো সময় খেলাপি হয়ে যেতে পারে। মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৩৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১২ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হয়েছে। যা তাদের খেলাপি ঋণের ৩৩ দশমিক ৭২ শতাংশ।

জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিয়মিত হিসাবে আছে ২২ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে ১১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা কুঋণে পরিণত হয়েছে এবং এটি আদায়ের সম্ভাবনা কম। এটি তাদের খেলাপি ঋণের ১৫.১৪ শতাংশ।

একটি সরকারি ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ২৯ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। নিয়মিত হিসাবে আছে ২২ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে ১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের ২০ শতাংশই খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত ৫ হাজার ১৭ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ১৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বেসিক ব্যাংকের ১৪ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত আছে ৫ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে ৩৮৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। তাদের মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ ৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। যা খেলাপি ঋণের ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ।

২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংক থেকে নজিরবিহীন জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ওই কারণেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর আগে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ শতাংশের কম। রূপালী ব্যাংকের ২০ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ১৫ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। খেলাপির আগের ধাপে আছে ৯২৭ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। যা তাদের মোট ঋণের ২২ শতাংশ। এর মধ্যে কুঋণ ৪ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। যা খেলাপি ঋণের ২০ দশমিক ৬০ শতাংশ।

কৃষি ব্যাংকের ১৮ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ১৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। খেলাপির অপেক্ষায় ১১৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।

কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৪ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। খেলাপি ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৮১৭ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী শরিয়াভিত্তিতে পরিচালিত একটি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। সে তুলনায় তাদের খেলাপি ঋণ অনেক কম। মোট ঋণের মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ খেলাপি। তবে পরিমাণে খেলাপি ঋণ বেশি। শতকরা হারে তাদের খেলাপি ঋণ কম থাকা এবং পর্যাপ্ত প্রভিশন থাকার কারণে তাদের ঝুঁকির মাত্রা কম। তাদের বিনিয়োগ করা ৭১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ৬৩ হাজার ৬০৮ কোটি টাকাই এখন নিয়মিত আছে। খেলাপির আগের ধাপে আছে ৩ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এদের মোট বিনিয়োগের মধ্যে খেলাপি ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। যা মোট বিনিয়োগের সাড়ে ৫ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ২ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। যা মোট বিনিয়োগের ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

বেসরকারি খাতের আরও একটি ব্যাংকের ২৪ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ২০ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে ১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। তাদের মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য কুঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। পূবালী ব্যাংকের ২৩ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত ২০ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা।

খেলাপির আগের ধাপে আছে ৫৩৬ কোটি টাকা। খেলাপির পরিমাণ ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ১৭ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, তাদের ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার বরাবরই কম। বড় ব্যাংক ঋণ বেশি এ কারণে টাকার অংকে খেলাপি ঋণ বেশি মনে হয়। কিন্তু শতকরা হারে কম। এছাড়া এর বিপরীতে যথেষ্ট প্রভিশন রাখা আছে।

বিসিবি ১ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে নিয়মিত ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ৪৫৩ কোটি টাকা। মোট ঋণের ২৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৩৯ কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের প্রায় পুরোটাই আদায় অযোগ্য।

দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বিডিবিএলের। তাদের মোট ঋণের অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৫ দশমিক ১৪ শতাংশই খেলাপি। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা মিলে এটি গঠন করা হয়। ফলে দুই সংস্থার দায়-দেনা এখানে রয়েছে। এদের বিতরণ করা ১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে নিয়মিত আছে ৫৬৮ কোটি টাকা।

খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে ৮৭ কোটি টাকা। খেলাপি ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য কুঋণের পরিমাণ ৭৬৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৮০ দশমিক ১৭ শতাংশ। তাদের বিতরণ করা ৮৭৬ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে নিয়মিত মাত্র ১৫৫ কোটি টাকা। খেলাপির আগের ধাপে আছে আরও ২০ কোটি টাকা। খেলাপি ৭০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে ৬৯১ কোটি টাকা।

সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ এনবিপির। তাদের মোট ঋণের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই খেলাপি। তাদের বিতরণ করা ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার মধ্যে নিয়মিত আছে মাত্র ৭৬ কোটি টাকা। খেলাপি ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। যার পুরোটাই আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version