আবদুল লতিফ মন্ডল
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কোনো রকম শর্ত ছাড়াই সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

১১ আগস্ট সকালে রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের অগ্রগতি পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এমন ইঙ্গিত করেন। ১২ আগস্ট একাধিক দৈনিক পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্যের উদ্ধৃতিসহ ১২ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘Dialogue can’t take place on condition and it should be held spontaneously. But BNP sets condition on all things’, যার অর্থ দাঁড়ায়- শর্ত আরোপ করে সংলাপ হতে পারে না। সংলাপ হতে হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কিন্তু বিএনপি সবকিছুতে শর্ত আরোপ করে বসে। অন্য একটি দৈনিকের (বাংলাদেশ প্রতিদিন) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘পূর্বশর্ত দিয়ে নয়, শর্তহীনভাবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে।’ এর আগে (২৭ জুলাই) ওবায়দুল কাদের বিএনপির সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নয়- এ অবস্থান থেকে সরে এসে প্রথমে টেলিফোনে আলাপ এবং পরে শর্তহীন সংলাপে বসার ইঙ্গিত প্রদানের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। জনগণের আশা, বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসবে এবং আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের পথ সুগম করবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপির সঙ্গে সংলাপ নয়- এমন অবস্থান থেকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সরে আসতে চাচ্ছে কেন? এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এক. বিদ্যমান বিএনপি জোটসহ সরকারের বাইরে থাকা কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

সম্ভাব্য জাতীয় ঐক্যে বিএনপি জোটের বাইরের একাধিক দলে এমন ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের প্রতি সুশীলসমাজের অধিকাংশ সদস্য ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন এমন জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এমন একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠলে এবং তারা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে তা শেষ পর্যন্ত কোনদিকে মোড় নেবে, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অনেকটা শঙ্কিত করে তুলেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের গণআন্দোলন এবং ১৯৯৪-৯৫ সময়কালে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দুর্বার আন্দোলন ও জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ ইত্যাদি ঘটনার স্মৃতিও দলটিতে এমন শঙ্কা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করছে। দুই. কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে বোমা হামলা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। মানহানির অভিযোগে নড়াইলে করা মামলায় খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার আপিল নিয়ে বর্তমানে আপিল বিভাগে শুনানি চলছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া মুক্ত হলে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন যে বেগবান হয়ে উঠবে সরকার তা জানে এবং বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তিন. সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বিচার এবং পাঁচ দফা দাবির আলোকে কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন প্রকাশে সরকারকে ফের আলটিমেটাম দিয়েছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ৩১ আগস্টের মধ্যে এসব দফা দাবি পূরণ না হলে ফের আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি জোট ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে বলে সরকার অনেকটা অস্বস্তিতে আছে।

চার. দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় দেশে-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গণতন্ত্রকামী বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেকটা একতরফা অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে একমাত্র সমর্থনকারী ভারতও বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি নিতে শেখ হাসিনার সরকারকে পরামর্শ দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে নির্বাচন-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি ও অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি তার সে প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এলেও তিনি যে তা ভুলে গেছেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ক্ষমতার শেষদিকে এসে তিনি তার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।

এদিকে ১৪ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিএনপি বিনা শর্তে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসবে। ওই সভার সূত্রের বরাত দিয়ে ১৫ আগস্ট যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংলাপের আহ্বান জানালে কোনো শর্ত ছাড়াই সাড়া দিতে প্রস্তুত বিএনপি। তবে এ আহ্বান কোনো সভা-সমাবেশে বক্তব্যের মাধ্যমে নয়, সেটি হতে হবে আনুষ্ঠানিকভাবে। অবশ্য এর আগেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের টেলিফোনে আলোচনার প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিলেন বিএনপির মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা ক্ষমতাসীন দলের এমন মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তখন টেলিফোনে আলোচনার জন্যও কোনো শর্ত আরোপ করা হয়নি। তারও আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি দৈনিক পত্রিকার (প্রথম আলো) সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, সামনের নির্বাচনকে কীভাবে সুষ্ঠু করা যায়, সে বিষয়ে তারা কোনো পূর্বশর্ত ছাড়াই সংলাপে বসতে রাজি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির মধ্যে যে গুটিকয়েক বিষয়ে মতানৈক্য ও বৈরিতা বিরাজ করছে সেগুলোর একটি হল সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। দ্বিতীয়টি হল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে জাতীয় সংসদ বহাল রাখা-না-রাখা। তৃতীয়টি হল আগামী সংসদ নির্বাচনকালে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা, না করা।

উল্লেখ্য, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেয়া এবং নির্বাচনকালে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা শুধু বিএনপির দাবি নয়, এগুলো সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ ও গণমাধ্যমের অধিকাংশ সদস্যের দাবি। গত বছর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এবং গণমাধ্যমের অধিকাংশ প্রতিনিধি সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনকালে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করার সুপারিশ করেন।

চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে গত মাসে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের টেলিফোনে আলোচনার প্রস্তাব এবং বিএনপি নেতাদের সেটি ইতিবাচক হিসেবে দেখাকে ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, টেলিফোনে আলোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে আসা সম্ভব না হলেও ফোনালাপের মধ্য দিয়ে দু’দলের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব অনেকটা কমে আসতে পারে। যদি ফোনালাপও হয় সেটাও রাজনীতির জন্য ইতিবাচক, যা পরে এক টেবিলে বসতে সহায়তা করবে। ‘শর্তহীনভাবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হতে পারে’- ১১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন মন্তব্য টেবিলে বসার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাই চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বড় দুটি দল ‘ওয়ান টু ওয়ান’ আলাপ করতে পারে বলে সুশীলসমাজের অনেকে মনে করেন। তারা আরও মনে করেন, সংলাপ অনুষ্ঠান ও সংকট সমাধানের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।

সবশেষে যা বলতে চাই, চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বড় দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা পূর্ণতা পাক। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে প্রধান কুশীলব, সেহেতু চলমান সংকট সমাধানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সংলাপ অনুষ্ঠিত হলে তা অধিকতর সুফল বয়ে আনবে বলে জনগণের বিশ্বাস।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version