সাইদ আহমেদ : প্রাচীনকালে বঙ্গ বলতে বর্তমানে পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) আর পশ্চিমবঙ্গের মিলিত যে অখণ্ড বঙ্গ, তাকে বোঝাত না। এর ভিন্ন ভিন্ন অংশের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। যেমন- বঙ্গ, গৌড়, রাঢ় বা সুহ্ম, বঙ্গাল, বরেন্দ্র, পুণ্ড্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি।

আধুনিককালে যে অংশ দুটোকে পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ বলা হয় তার পূর্ববঙ্গভুক্ত ছিল বঙ্গ, বঙ্গাল, বরেন্দ্র, পুণ্ড্র, হরিকেল, সমতট অঞ্চলগুলো এবং পশ্চিমবঙ্গভুক্ত ছিল রাঢ় বা সুহ্ম, গৌড় ইত্যাদি অঞ্চল।

হিন্দু-বৌদ্ধযুগে দেশের পশ্চিমাংশের একক নাম হয় গৌড়, যেহেতু গৌড় অঞ্চল পশ্চিমাংশভুক্ত ছিল আর পূর্বাংশের নাম হয় বঙ্গ, যেহেতু বঙ্গ অঞ্চল পূর্বাংশভুক্ত ছিল। তা ছাড়া বঙ্গ আর গৌড় হয়তো সেকালে কোনো বিশেষ কারণে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ছিল। সেই বিশিষ্ট নাম দুটিই দেশের দুটি অংশের নাম হয়ে যায়। সুতরাং দেশের সমগ্র অঞ্চলের নাম দাঁড়ায় গৌড়-বঙ্গ। তখন পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ-এমন নাম বলা হতো না।

এসব নাম এসেছিল অনেক পরে ইংরেজ আমলে দুটি প্রদেশ গঠনের পরে। পরে আবার একটি প্রদেশ করা হয় আগের মতো। অবশ্য অদৃশ্য একটি বিভাজন ছিলই পূর্ব আর পশ্চিমাংশের মধ্যে। এই দুই অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে সামাজিক কোনো মিল ছিল না। পশ্চিমাংশে হিন্দু ব্রাহ্মণ নিজেকে উচ্চ কৌলীন্যের ব্রাহ্মণ বলে দাবি করত, আর তারা পূর্বাংশের ব্রাহ্মণকে নিু কৌলীণ্যের ব্রাহ্মণ বলে মনে করত। ফলে তাদের মধ্যে বিবাহাদি সম্পন্ন হতো না।

বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’-এ এভাবে বলেছেন : ‘বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ রাঢ় বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না।’ রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছেন : ‘তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।’

প্রাচীনকালে হিন্দু-বৌদ্ধ রাজারা নিজেদের গৌড়াধিপ অর্থাৎ গৌড়রাজ বলতে গৌরববোধ করতেন। মুসলিম আমলে সমগ্র দেশের নাম দেয়া হয় বঙ্গাল। এ শব্দ ‘বঙ্গ’ শব্দ থেকে সৃষ্ট, যা ‘আকবরনামা’য় পাওয়া যায় : বঙ্গ+আল= বঙ্গাল। এখানে আল হল জমির আল বা আইল। নদীমাতৃক এ দেশে জোয়ারের পানি ঠেকিয়ে রাখতে বা বৃষ্টির পানি বার করে দিতে জমিতে বড় বড় আল বা বাঁধ দিতে হতো। ফলে দেশে এসবের প্রাচুর্য ছিল। তাই আল এত গুরুত্ব পেয়েছিল। পরে এ দেশে আগত পর্তুগিজরা বঙ্গালকে বলত Bengala, অর্থাৎ বঙ্গালা। বঙ্গালা শব্দ দেশি সহজাত উচ্চারণের নিয়মে স্বরধ্বনি পরস্পর পরিবর্তনের দ্বারা হয়ে যায় বাঙ্গলা। পরে বাঙ্গলা হয় বাঙলা বা বাংলা।

এই বাংলা শব্দ দ্বারা দেশ এবং ভাষা উভয়কেই বোঝানো হতো, যার মূলে রয়েছে বঙ্গ শব্দ। তবে বঙ্গ শব্দে কেবল দেশকে বোঝাত এবং এখনও বোঝায়। আবার দেশ বোঝাতে বঙ্গ আর বাংলা শব্দের সঙ্গে কখনও কখনও ‘দেশ’ শব্দও অতিরিক্ত হিসেবে দেখা যায়।

এসবই হয়েছে যখন দুই বাংলা অবিভক্ত অবস্থায় ছিল তখন, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগে। তখন সাহিত্যে, কাব্যে, গানে, ভাষণে, লেখায় সমগ্র দেশবাচক ‘বঙ্গ’, ‘বাংলা’, ‘বাংলাদেশ’ এবং আমাদের ভাষাবাচক ‘বাংলা’ শব্দের ব্যাপক ব্যবহার ঘটেছিল। যেমন- রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘আমার সোনার বাংলা’; ডি এল রায়ের ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার’, জীবনানন্দের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’; নজরুলের ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম’ ইত্যাদি। ইদানীং একজন কবি লিখেছেন ‘আমি বাংলায় কথা কই’।

এই কবিতা দুই বাংলায়ই আবৃত্ত ও গীত হয়। এই ‘বাংলা’ শব্দ বাঙালির ভাষাকে নির্দেশ করে। এটা কী করে সম্ভব? এটা হয়েছে ‘ভাষার ঐক্যের জন্য’। উভয় বাংলায় মানুষ এক ভাষায় কথা বলে। সুতরাং দেখা যায় আমাদের ভাষায় এমন কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলো উভয় অঞ্চলের জন্য ব্যবহারসিদ্ধ এবং উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যও বটে। যেমন- বঙ্গ, বাঙ্গাল, বাঙালা, বাংলা, বাংলাদেশ।

কিন্তু যখন পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হল, তখন কিন্তু ‘পূর্ববঙ্গ’ নাম গ্রহণ করা হল না; হল ‘বাংলাদেশ’। এই নাম নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। যতদূর মনে পড়ে পশ্চিম বাংলার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ সে প্রশ্ন তুলেও ছিলেন। তেমনভাবেই পশ্চিমবঙ্গের প্রস্তাবিত ‘বাংলা’ নাম নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। দুটি নামই যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি করে এবং করবে। রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ কি কেবল পূর্ব বাংলার জন্যই লিখেছিলেন? আমাদের দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’। তা হলে নজরুল কি কেবল আমাদের দেশের জন্যই ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি লিখেছিলেন? কোনোটিরই উত্তর হ্যাঁবোধক হবে না।

২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের নাম যখন প্রথম পাল্টানোর প্রস্তাব ওঠে, তখন এই নিবন্ধকার আবেগীয় চপলতায় পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘গৌড়’ প্রস্তাব করেছিলেন, যা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল (দেখা গেল এবার পশ্চিমবঙ্গের নাম পাল্টানোর আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে যেসব নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল তার মধ্যে গৌড়ও ছিল)। প্রস্তাবটি ছিল ভুল। ঐতিহাসিক সত্যের কাছে আবেগের কোনো স্থান নেই।

বাঙালিদের বাসস্থানের নাম বঙ্গ, বঙ্গদেশ, বঙ্গভূমি, বাংলা, বাংলাদেশ আর বাংলাভূমি। এর দুটি অংশ, একটির নাম পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব বাংলা আর অন্যটির নাম পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিম বাংলা। এ দুটি নাম নৃতত্ত্বগত বা নৃতাত্ত্বিক নয়; রাজনৈতিক। আর বিভাজনটা ধর্মভিত্তিতে এবং সেটা বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা চূড়ান্তভাবে সম্পাদিত। এ নাম দুটির বাইরে এদেরকে আর কোনো নামেই ডাকা যায় না, যদি আমরা বাঙালির যৌথ ঐতিহ্যগুলোকে স্বীকার করি।

পূর্ববঙ্গের নাম ‘বাংলাদেশ’ যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েই গেছে, একে আর পাল্টানো যাবে না, তখন পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ রাখার আর কোনো পথ নেই। কারণ ‘বাংলাদেশ’ আর ‘বাংলা’ একই শব্দ।

পশ্চিমবঙ্গের অনেকে এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘দুই অংশের একই নাম তো থাকতেই পারে, যেমন পাকিস্তান আর ভারত উভয় দেশের পাঞ্জাবের নাম একই।’ কিন্তু পাঞ্জাবে যেটা সম্ভব, বঙ্গে সেটা সম্ভব নয়। কারণ পাঞ্জাবের দুই অংশ একই ঐতিহ্য স্বীকার করে নেয়নি। পশ্চিমাংশ পাঞ্জাবি লিপি গ্রহণ না করে মানসিক, বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে পাঞ্জাবি ঐতিহ্য থেকে নিজেকে দূরে সরে রেখেছিল। কিন্তু বঙ্গে সেরকম ঘটেনি।

পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র নয়; ভারত ইউনিয়নভুক্ত একটি প্রদেশ। একদিন না একদিন পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীন হবেই। তখন কোনটি হবে তাদের জাতীয় সঙ্গীত? নিশ্চয় আমার সোনার বাংলা নয়? তাদের মেধাবী গীতিকাররা জাতীয় সঙ্গীত রচনা করে নেবে (অবশ্য পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রদেশগুলোর জন্য স্বায়ত্তশাসন থাকে, পৃথক পতাকা, পৃথক জাতীয় সঙ্গীতও থাকতে পারে। তা ছাড়া গণভোটের মাধ্যমে তাদের স্বাধীন হওয়ার অধিকারও থাকতে পারে।

গণতন্ত্রের এটাই মূল কথা। ভারতকে একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হয়। সেখানে কি উল্লিখিত ব্যবস্থাদি রয়েছে? না থাকলে ভারতের সেটা কেমন গণতন্ত্র!)। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের নাম আর যা-ই রাখা হোক, বাংলা হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে গুবলেট পাকিয়ে যাবে।

সাইদ আহমেদ : অবসরপ্রাপ্ত এডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, সওজ

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version