এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের সব সিটি কর্পোরেশনের আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে দু’বছর আগে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতা না থাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম অনেক ক্ষেত্রে আরও জেঁকে বসেছে।

মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পরপরই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জোরেশোরে কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, খুলনা সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশন কাজ শুরু করে। আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে সিটি কর্পোরেশনগুলোর সঙ্গে মাঠে নামে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এবং গণপূর্ত অধিদফতর। এলজিআরডি মন্ত্রণালয়কে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

হাঁকডাক দিয়ে শুরু হওয়া আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের উদ্যোগে দেশবাসী আশায় বুক বাঁধলেও শেষমেশ তা গতানুগতিক উদ্যোগে পরিণত হয়। প্রথমে লোক দেখানো কিছু চিঠি ইস্যু করা হলেও তা অব্যাহত রাখা হয়নি। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে ঢাকায় প্রথম ৬-৭ মাস কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করা হলেও রাজধানীর বাইরে সিটি কর্পোরেশনগুলোয় তেমন কোনো কার্যক্রম লক্ষ করা যায়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, ভালো উদ্দেশ্যে আবাসিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় বড় বাধা আসে। অনেক জনপ্রতিনিধি বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্তাব্যক্তিরা আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাও নানাভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধা দেন। শত শত মামলায় উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ (স্টে অর্ডার) দেন। এসব কারণেই মূলত হাঁকডাক দিয়ে শুরু করা আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ব্যাপারে এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। সংস্থাগুলোও সেভাবে কাজ করছে। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

প্রকৌশল ও নগর বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানোর মূল কাজ করতে হবে রাজউককে। তবে এ ধরনের কাজ করার ব্যাপারে রাজউকের যথেষ্ট অনীহা রয়েছে এবং এটি নগরবাসীর কাছে পরিষ্কার। আর ঢাকার বাইরে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। যেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, সেখানে সিটি কর্পোরেশনকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাউকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি। স্থপতি ও নগরবিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের উদ্যোগ সফল না হওয়া খুবই হতাশাজনক। সরকারের এ উদ্যোগ সফল না হওয়ার পেছনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো মূলত দায়ী। শহরগুলো বাসযোগ্য রাখতে সমস্যাগুলো সুপরিকল্পিতভাবে সমাধান করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের জন্য চিঠি ইস্যু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ৮-১০ দিনের সময় দিয়ে প্রথম চিঠি এবং এরপর কারণ দর্শানোর নোটিশ করার কথা ছিল সংস্থা দুটির। কারণ দর্শানোর জবাব পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ছিল। সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্লটটি বাণিজ্যিকীকরণ করা হলে বা আদালতের কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকলে প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বহাল রাখার কথা। অন্যথায় সময় বেঁধে দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা। সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি রাজউককে নোটিশ ইস্যু করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এরপর পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন সেবা কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে চিঠি ইস্যু করে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকার ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দিলেও এরই মধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। আর কখনও এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে কোনো অগ্রগতি জানানো হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ছয় মাসের মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশের আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ১৫ দিন পরপর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কয়েকটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলেও এরপর থমকে গেছে মনিটরিং কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে এই কমিটির সভা থেকে ঢাকা শহরের ৬ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপসারণের ব্যাপারে এলাকাবাসীর মতামত নেয়া হবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version