এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : সিরিয়ায় দীর্ঘ সাত বছরের যুদ্ধ সমাপ্তির পথে। আট বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে জেগে ওঠা আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়া ভূমিতে ধাক্কা দেয় এক বছর পর। এরপরের সাত বছরে দেশটি প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ২৫ লাখ আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বাশার আল-আসাদ সরকার কর্তৃক পরিচালিত সর্বশেষ অভিযান ছিল আলেপ্পোতে। সেখানে অভিযান শুরু করার পর বিদ্রোহীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত হয়ে আসাদবিরোধীরা বর্তমানে ইদলিবে অবস্থান করছে। সেখানে বিদ্রোহীদের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। তবে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রায় ২৫ লাখ সাধারণ মানুষ রয়েছে, যারা এখন কার্যত জিম্মি।
ইদলিবের ভেতরে রয়েছে বিদ্রোহী আর বাইরে রয়েছে আসাদ বাহিনী। বর্তমানে ইদলিব শহরের চারপাশ ঘিরে রেখেছে সরকারি বাহিনী, যাদের পেছনে রয়েছে রাশিয়া ও ইরানের সর্বাত্মক সহায়তা।
ইদলিবে আসাদ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে আসাদের পক্ষে বিমান হামলা চালাতে প্রস্তুত রয়েছে রাশিয়ার বাহিনী। সব রকম সহায়তা করতে প্রস্তুত ইরানি সামরিক উপদেষ্টারা।
ইদলিবে আসাদ বাহিনীর অভিযানের এ প্রস্তুতি উদ্বিগ্ন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান। ইতিমধ্যে তিনি এ অভিযান বাতিল করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন।
তুরস্কের আশঙ্কা, ইদলিবে অভিযান চালালে সেখানে ভয়াবহ ধ্বংসজ্ঞ সৃষ্টি হবে। তুরস্কের ওপর শরণার্থীর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।
এছাড়া সিরিয়ায় তুরস্ক সমর্থিত কিছু গোষ্ঠী রয়েছে; যারাও বর্তমানে ইদলিবে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে এলোপাতাড়ি অভিযান চালালে তুরস্ক সমর্থিতরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরস্ক ইদলিবে অভিযানের বিরোধিতা করছে। কিন্তু আসাদ সরকার সেখানে অভিযান চালাতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠান। আসাদ সরকারের সমর্থনে রাশিয়া বলছে, সিরিয়ার সম্পূর্ণ ভূখণ্ডে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে।
এদিকে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি সিরিয়া সফর করেছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের পরপরই সেখানে সফরে রয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ।
সোমবার আসাদের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি বলেছেন, ইদলিবে বর্তমান যেসব সন্ত্রাসী আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে অবশ্যই নির্মূল করা হবে। ইদলিবে অবশ্যই সিরিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
তুরস্কের সামরিক কর্মকর্তা বলছেন, ইদলিবে অভিযান চালানো হলে সেখানে অবস্থানরত ২৫ লাখ সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেবে। কেউ জানে না তাদের ভাগ্যে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে! একজন মানুষের স্বপ্ন সাধ সব ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে।
ইতিপূর্বে সিরিয়ার অন্যান্য প্রদেশে বিদ্রোহী দমনে দেখা গেছে- সিরিয়ান বাহিনী ও রাশিয়ান সেনাদের সহায়তায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে। হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, অসংখ্যা মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
ইদলিব অভিযানে রাশিয়া কেমন ভূমিকা রাখতে পারে সেটা বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়া ইদলিব অভিযানে সমর্থন দেবে সেটা তারা পরিষ্কার করেছে।
কিন্তু তুরস্কের তৎপরতায় রাশিয়া পিছিয়ে আসবে কিনা বা সিরিয়াকে এ অভিযান নিবৃত্ত করবে না কিনা তা এখনো বোঝার সময় আসেনি। তবে তুরস্কের আহ্বানে যে রাশিয়া সাড়া দিয়েছে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
১৭ আগস্ট ঈদের ছুটি শুরু হলে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এমআইটি) প্রধান হাকান ফিদান রাশিয়ায় গিয়েছিলেন দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইদলিব বিষয়ে আলোচনা করতে।
তুরস্কের আফরিন ও ইউফ্রেটিস শিল্ড অপারেশনে একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। অর্থাৎ বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনা ও বোঝাপড়ার পর অভিযানগুলো পরিচালিত হয়।
টেবিলে মানচিত্র রাখা হয়, টেবিল ঘিরে আলোচনা চলে, আপস মীমাংসা হয়, সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত হয় এবং এসবের পর অভিযান পরিচালনা করা হয়। আলোচনার টেবিলে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযান পরিচালিত হয়।
তবে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও এমআইটি প্রধান সমঝোতার মধ্যমণি এমনটি ভাবার যৌক্তিকতা নেই। কারণ মাত্র কিছু দিন আগে সিরিয়া ইরানি স্থাপনায় যখন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল হামলা চালিয়েছিল তাতে সমর্থন দিয়েছিল তুরস্ক। আর প্রেসিডেন্ট এরদোগান বরাবরই বাসার সরকারের বিরোধিতা করে আসছে।
ফলে সিরিয়া সরকার এরদোগানের আহ্বানের তেমন গুরুত্ব দেয়ার কারণ নেই। ইরানও ইদলিব নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগকে গুরুত্ব না দেয়াটাই স্বাভাবিক। এখানে মূল কারিগর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে রাশিয়া। রাশিয়ার সহায়তা ছাড়া বা রাশিয়াকে উপেক্ষা করে আসাদ সরকারের পক্ষে ইদলিবে অভিযান চালানো সম্ভব নয়।
তুর্কি সরকারের উদ্বেগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে রাশিয়া অভিযান ছোট করতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে খবর প্রকাশ করা হয়েছে। তবে মস্কোতে তুর্কি প্রতিনিধের সঙ্গে রাশিয়ার কী কী বিষয়ে মত বা দ্বিমত হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
তবে তুরস্কের প্রতিনিধি দলের দ্বিতীয়বার রাশিয়া যাওয়ায় মনে করা হচ্ছে, দুই দেশ ইদলিব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বা শান্তিপূর্ণ কোনো উপায়ের কাছাকাছি রয়েছে।
তুর্কি প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসগলু। সফর শেষে তিনি বলেছিলেন, তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়ে কোন কোন দেশ হিংসা করছে। অন্যদিকে পুতিন বলেছিলেন, আমরা তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চাই।
দুই দেশের মধ্যে এমন ইতিবাচক চিত্র বলে দিচ্ছে, ইদলিব প্রসঙ্গে তুরস্কের উদ্বেগ আমলে নিয়েছে রাশিয়া। এমন আশাবাদের পাশাপাশি আশাভঙ্গেরও শঙ্কা রয়েছে।
ইদলিবকে আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে যেসখানে মারাত্মক অভিযান চালানো ছাড়া আপাতত কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। অভিযান চালালে ব্যাপক মাত্রায় হতাহতের ঘটনা ঘটবে।
এর আগে আলেপ্পোসহ অন্যান্য প্রদেশের অভিযানের ক্ষেত্রে এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে। সে জন্য রাশিয়া ও আসাদ বাহিনী হিংস্রতার পরিচয় দিতে পারে সে আশঙ্কা রয়েই গেছে।
২০১৬ সালের শেষের দিকে আলেপ্পোতে অভিযানের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বিদ্রোহীদের এলাকা ছেড়ে দিতে সময় ও সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইদলিব চারদিক দিয়ে ঘেরাও হয়ে আছে। এর আশপাশের এলাকা এখন সিরিয়া সেনাদের দখলে রয়েছে।
তবে ৭ সেপ্টেম্বর ইরান-তুরস্ক-রাশিয়া ত্রিদেশীয় যে সম্মেলন তেহরানে হওয়ার কথা রয়েছে সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ইদলিব ইস্যু আলোচিত হবে। ওই সম্মেলনের পরেই হয়তো নিশ্চিত হবে ইদলিববাসীর ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে।
লেখক: দৈনিক যুগান্তরের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সাংবাদিক।