এশিয়ান বাংলা, কুষ্টিয়া : ৩১ বছর আগে এক সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন কুষ্টিয়া সদর থানার বংশীতলা গ্রামের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ।
খুনের পর মামলাও হয়েছে, মামলার তদন্তও ঘুরেছে একাধিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে। তিন দশকেরও বেশি সময় লেগেছে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, মামলার বাদী নিজেই খুন করেছেন নূর মোহাম্মদকে! প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খুন করা হয় তাকে।
পিবিআই জানায়, দরিদ্র নূর মোহাম্মদ শ্বশুরবাড়ি বংশীতলা গ্রামে বসবাস করতেন। সেখানে মাজেদ আলী জোয়ার্দার ও আলতাফ মোল্লা নামে দুইজন মাতুব্বর ছিলেন, এলাকায় তাদের কথাই ছিল শেষ কথা। মাজেদ আলীর বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন নূর মোহাম্মদ।
১৯৮৭ সালে জুন মাসের এক সন্ধ্যায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় খুন হন নূর মোহাম্মদ। এ ঘটনার পরদিন ২৫ জুন কুষ্টিয়া সদর থানায় মাজেদ আলী বাদী হয়ে মামলা (মামলা নং-২৬) করেন। মামলায় আসামি করা হয় গ্রামের আরেক মাতুব্বর আলতাফসহ ১৩ জনকে। এরপর রহস্য ভেদের দিনগণনা শুরু হয়, এক এক করে কেটে যায় ৩১ বছর।
ঘটনার প্রায় দুই মাস পর মামলাটি পুলিশের তদন্তকারী সংস্থা (সিআইডি) তে হস্তান্তর করা হয়। এর কয়েক মাস পর নূর মোহাম্মদের স্ত্রী তহরুন্নেসা ‘তদন্ত সঠিক হচ্ছে না’ মর্মে অভিযোগ এনে আদালতে ফৌজদারী মিস মামলা দায়ের করেন। ছয় মাস শুনানি শেষে আদালত সেই অভিযোগ খারিজ করে দেন। অর্থাৎ খুনের মামলার তদন্ত সঠিক হচ্ছে।
এদিকে তদন্তের সময় চলে যাচ্ছিল বলে সিআইডি আদালতের কাছে দুই মাস সময় বৃদ্ধির অনুমতি চায়। আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর নূর মোহাম্মদের স্ত্রী ‘তদন্ত সঠিক হচ্ছে না’ ও ‘তদন্ত সময় এক মাস বৃদ্ধি’ আদেশ দুইটির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন করতে আদালতে আবেদন করেন এবং রিভিশন চলাকালীন মামলার ডকেট আদালতে রাখতে চান।
আবেদন অনুযায়ী আদালতের নির্দেশে কেস ডকেট সিআইডি থেকে আদালতের হেফাজতে চলে আসে। রিভিশন মামলা দুইটির প্রায় ছয় বছর শুনানি শেষে হাইকোর্ট জেলা আদালতের পক্ষেই রায় দেন। এরপর সিআইডি আবার মামলার তদন্ত শুরু করে।
এরপর সিআইডি নূর মোহাম্মদের ছেলে আমিরুলকে দিয়ে কুষ্টিয়া সদর থানায় আরেকটি নতুন হত্যা মামলা দায়ের করায়। এ মামলায় আগের মামলার বাদী মাজেদসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। একইদিন সিআইডি আগের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠায়। রিপোর্টে আলতাফসহ অন্য আসামিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে, প্রথম মামলার বাদী মাজেদ সিআইডি’র ‘ফাইনাল রিপোর্টের’ বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ‘না রাজি’ দেন, অর্থাৎ এ মামলাও চলবে। নিয়ম অনুযায়ী একই ঘটনায় দুইটি মামলা চলতে পারে না। ফলে দ্বিতীয় মামলাটির তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
তখন মাজেদ নূর মোহাম্মদ খুনের ন্যায়বিচারের জন্য ‘না-রাজি’, ‘আপিল’, ‘রিভিশন’ ও ‘আদালত পরিবর্তন’সহ বিভন্ন পন্থায় চেষ্টা করতে থাকেন। এদিকে, নূর মোহাম্মদের স্ত্রীসহ পরিবার ততদিনে সব আশাই ছেড়ে দেয়।
বাদী মাজেদের বয়স ৯০ বছর। মৃত্যুশয্যায় থাকা মাজেদ আদালতেও যান না। এ বিষয়ে সব তদবির থেমে যাওয়ায় গত বছর আদালত ১ম মামলার ফাইনাল রিপোর্টটি গ্রহণ করেন এবং নূর মোহাম্মদের ছেলে আমিরুলের দায়ের করা ২য় মামলাটির তদন্ত পিবিআই’তে দেন।
খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় তিন দশক আগের একটি খুনের ঘটনায় পিবিআই প্রমাণ পায় প্রথম মামলার বাদী মাজেদ আলীর প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও উপস্থিতিতে ১০ জন মিলে নূর মোহাম্মদকে খুন করা হয়। খুনের আগ মুহূর্তে অন্ধকারে চিৎকার করে গ্রামে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যেন কোনো সাক্ষী না থাকে। সেই মাজেদ আলীই নূর মোহাম্মদের স্ত্রীকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে নিজে মামলার বাদী হয়েছিলেন।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সোমবার (৩ সেপ্টেম্বর) এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
ঘটনার বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নূর মোহাম্মদ খুনের ঘটনায় পিবিআই ইতোমধ্যে মাজেদ আলী জোয়ার্দারসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে। অন্য দুইজন ইতোমধ্যে বার্ধ্যক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। বাকি আটজনের অনেকেই মাজেদ আলীর মতো মৃত্যুশয্যায় রয়েছেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version