আবদুল লতিফ মন্ডল : দেশে বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত যুব বেকারত্ব কী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে ২৯ আগস্ট যুগান্তরে প্রকাশিত ‘খাদ্য অধিদফতরে ১১৬৬ পদে ১৪ লাখ আবেদন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তার প্রমাণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য অধিদফতরের খাদ্য উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শকসহ ২৪ ক্যাটাগরিতে এক হাজার ১৬৬টি পদে লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে। এসব পদের বিপরীতে ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৩টি আবেদন জমা পড়েছে।

অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণীর এসব চাকরি পেতে প্রতিটি পদের জন্য চাকরিযুদ্ধে লড়তে হবে এক হাজার ১৮২ জনকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত গত কয়েকটি লেবার ফোর্স সার্ভে বা শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যুব শ্রমশক্তির, বিশেষ করে শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে।

বেকারত্বের হার নির্ধারণে বিবিএস আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুসরণ করে আসছে। আইএলও’র সংজ্ঞায় বেকার হচ্ছে যারা জরিপের সময় থেকে গত এক মাসের মধ্যে কাজ খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি।

অন্যদিকে যারা সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করেছেন (মূল্য পরিশোধ হোক বা না হোক), তাদের কর্মে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া যারা এক মাসের মধ্যে কোনো কাজ খোঁজেননি, তারা শ্রমশক্তির বাইরে থেকে যান।

বিবিএসের সর্বশেষ লেবার ফোর্স সার্ভে প্রতিবেদনে (২০১৬-১৭) বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ আছে।

২০১৬-১৭ সালের সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। ২০১০ সালের লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্টে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

২০০৫-০৬ এবং ১৯৯৯-২০০০ সালের দুটি সার্ভে রিপোর্টেই জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে ১৯৯৫-৯৬ সালের সার্ভে রিপোর্টে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশে। এতে দেখা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬-১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হ্রাস পেলেও ১৯৯৫-৯৬ সালের তুলনায় তা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

আইএলও’র সংজ্ঞা মেনে পরিচালিত বিবিএস-এর ২০১৬-১৭ সালের সার্ভে রিপোর্টে উঠে আসা ৪ দশমিক ২ শতাংশ বেকারত্ব হারের সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, আইএলও’র সংজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

তাদের মতে, বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়াসহ তিন কারণে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয় নেই। অর্থাৎ যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে একই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না।

ফলে এই প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান তৈরিতে তেমন ভূমিকা রাখছে না। এছাড়া বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়া এবং সরকারি বিনিয়োগের কার্যকর ব্যবহার না হওয়া। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তারা মনে করেন, কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে চার কোটির বেশি মানুষ প্রকৃত বেকার। সুতরাং দেশে বেকারত্বের হার সরকারি রিপোর্টে নির্ধারিত ৪ দশমিক ২ শতাংশের অনেক গুণ বেশি।

এবার শিক্ষিত যুব বেকারত্ব প্রসঙ্গ। ২০১৬-১৭ সালের লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার অনেক বেশি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা সম্পন্ন করেছে এমন যুবশক্তির (১৫-২৯ বছর) বেকারত্বের হার যথাক্রমে ২৮ দশমিক শূন্য, ২২ দশমিক ৩ এবং ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

২০১০ সালের সার্ভে রিপোর্টে জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হলেও শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার ছিল বেশি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং মাস্টার্স পর্যায়ে বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৩, ১৩ দশমিক ৭৪, ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ।

ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল ডিগ্রিধারীদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। এ হার ছিল ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে যারা প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এবং ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল, তাদের বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, গত দুটি (২০১০ এবং ২০১৬-১৭ সাল) শ্রমশক্তি জরিপে শিক্ষিত যুব (১৫-২৯ বছর) বেকারত্বের হার জাতীয় পর্যায়ে বেকারত্বের হারের তুলনায় অনেক বেশি, যা বিশিষ্টজনদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করেন, এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে তা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।

শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার বৃদ্ধির জন্য যেসব কারণ মূলত দায়ী সেগুলো হল- এক. সাধারণত শহুরে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি। অভিজ্ঞজনদের মতে, এর মূল কারণ শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য। বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।

বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ না হওয়া এবং সরকারি বিনিয়োগের কার্যকর ব্যবহার না হওয়াকে এজন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। আবার বেশির ভাগ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী নিজস্ব ব্যবসা বা আত্মকর্মসংস্থানে আত্মবিশ্বাসী নয়।

ফলে শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই. তরুণ-তরুণীদের লক্ষ্যহীন শিক্ষা গ্রহণ। শ্রমবাজারে কোন ধরনের শ্রমের চাহিদা আছে, তা না বুঝে তারা অনেকটা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার অনেকাংশে মিল না থাকায় বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।

তিন. সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং মালয়েশিয়ায় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যে শ্রমশক্তি রফতানি করি তাদের প্রায় সবাই স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। তারা সবাই কায়িক পরিশ্রম করে। কারিগরি জ্ঞানহীন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বিপুল যুবশক্তির চাহিদা এসব দেশে নেই বললেই চলে।

তাছাড়া বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানিতে ভাটা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সেখানে শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হচ্ছে। বাংলাদেশিদের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার কয়েক বছর ধরে বন্ধ। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় বর্তমান পদ্ধতিতে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো সম্প্রতি নিষিদ্ধ করেছে সে দেশটির সরকার।

আওয়ামী লীগ প্রায় দশ বছর একটানা ক্ষমতায় রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে দলটি যে নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রকাশ করে তাতে যেসব বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং বেকারত্বের হার কমিয়ে আনা। এতে ২০১৩ সালের মধ্যে বেকার জনসংখ্যা ২৪ লাখে এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা ১৫ লাখে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু দশ বছরে বেকারত্বের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে।

২০১০ সালের সার্ভে রিপোর্টে দেশে বেকারের সংখ্যা দেখানো হয়েছিল ২৬ লাখ, যা ২০০৫-০৬ ছিল ২১ লাখ। ২০১৬-১৭ সালের সার্ভে রিপোর্টে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। বেকারত্বের হারেও তেমন কোনো হ্রাস ঘটেনি, বরং ১৯৯৫-৯৬ সালের তুলনায় বর্তমানে বেকারত্বের হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা গেছে, শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার বেড়েছে অনেকটা জ্যামিতিক হারে।

অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, শিক্ষিত যুবশক্তির বেকারত্ব বিপজ্জনক। তাদের মতে, সাধারণ একজন মানুষের অপরাধী হওয়ার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক অবস্থার একটি সম্পর্ক রয়েছে। একজন শিক্ষিত যুবক সঠিক সময়ে সাফল্যের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারলে তার অপরাধীতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে একজন শিক্ষিত যুবক সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারলে তার মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়।

আমরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে একজন বেকার যুবকের প্রতি সহানুভূতিশীল নই। পারিবারিক ও সামাজিক উপেক্ষা একজন বেকার যুবকের, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। হতাশা তার মধ্যে ধীরে ধীরে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণার জন্ম দেয়।

সে পরিণত হতে পারে একজন অপরাধীতে। সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পরিবারের জন্য বয়ে আনতে পারে অসহনীয় যন্ত্রণা; ভিড়তে পারে ছিনতাইকারী ও সন্ত্রাসীদের দলে; যোগ দিতে পারে কোনো রাজনৈতিক দলে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট চাঁদাবাজদের সঙ্গে; জড়িয়ে পড়তে পারে নিষিদ্ধ ড্রাগ ট্রাফিকিংয়ের সঙ্গে; নিয়োজিত হতে পারে একজন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকের মাসলম্যান হিসেবে; যোগ দিতে পারে উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোয়।

এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী যে কোনো কার্যকলাপের সঙ্গে শিক্ষিত বেকার যুবকরা জড়িত হয়ে পড়তে পারে। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর ও অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এসব কার্যকলাপ সম্ভাবনার পর্যায়ে নেই, বরং বাস্তবে অহরহ ঘটছে। এভাবে শ্রমশক্তির চূড়ামণি যুব শ্রমশক্তি সমাজবিরোধী ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।

সবশেষে বলতে চাই, শিক্ষিত যুবশক্তি আমাদের পরম সম্পদ। অথচ এ সম্পদের একটি বিরাট অংশ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। শিক্ষিত যুব শ্রমশক্তির যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

রাষ্ট্রের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করবে সরকার। এটাও ঠিক যে, কোনো সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকেই মূল দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়ন।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version