এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের রফতানি বাণিজ্যে। আগামী ডিসেম্বরের শেষদিকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি পোশাক রফতানিকারক ও বিদেশি ক্রেতাদের আশঙ্কা, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

এমন আশঙ্কায় নতুন ক্রয় আদেশের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চল’ নীতি অনুসরণ করছেন ক্রেতারা। পাশাপাশি আগে যেসব রফতানি ক্রয় আদেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলো দ্রুত শিপমেন্ট বা জাহাজীকরণ করার তাগিদ দিচ্ছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রফতানিকারকরাও ওইসব আদেশ দ্রুত সরবরাহ করতে দিনরাত কারখানা চালু রেখে কাজ করছেন। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ এবং ইএবি (এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)-এর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রাইজিং ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, প্রতি ৫ বছর অন্তর জাতীয় নির্বাচন সামনে এলে স্বাভাবিক কারণেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের এটা আরও বেশি থাকে। এর যৌক্তিক কারণও আছে। তিনি বলেন, প্রত্যেক ক্রেতারই বাংলাদেশে শাখা অফিস আছে। তারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখেন এবং ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় বার্তা দেন। আসন্ন নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে- এমন আশঙ্কা আছে ক্রেতাদের। যে কারণে তারা সতর্কতার সঙ্গে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বিগত নির্বাচনকালীন অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেখা গেছে, সাধারণত এ সময় ক্রেতারা ৫-১০ শতাংশ পর্যন্ত অর্ডার কমিয়ে দেন। আবার যেটুকু অর্ডার দেন সেটুকুও দ্রুত সরবরাহ পেতে চান। এর ফলে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অর্ডার সরবরাহ দিতে কারখানার উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটা বাড়তি চাপ তো থাকেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমনিতেই এখন চলছে পোশাক রফতানির ভর মৌসুম। বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকার পোশাক রফতানির বড় বাজার হচ্ছে শীতের মৌসুম। ওইসব অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশি থাকে বলে শীতের আগে থেকেই পোশাকের চাহিদা বেড়ে যায়। এ ছাড়াও ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উপলক্ষে পোশাক কেনার ধুম পড়ে যায়। এই বাজার ধরতে আমেরিকা ও ইউরোপের বড় বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো জুনের মধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে। ওই সময়েই তারা অর্ডার দিতে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে সেই অর্ডার সরবরাহ পেতে চায়।

ওই সময়ে পণ্য পেয়ে তারা নভেম্বরের মধ্যেই ওইসব পণ্য তাদের সব শোরুমে তুলতে চায়। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তাদের ব্যবসা মার খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেহেতু বাংলাদেশে অস্থিরতার আশঙ্কা থাকে, সেহেতু ক্রেতারা এবার আগাম সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। নির্বাচনী বাতাস উত্তপ্ত হওয়ার আগেই পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন।

ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী অর্ডার সরবরাহ করতে রফতানিকারকরা তাদের কারখানাগুলোতে দিনরাত কাজ করছেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাক কেনে, তাদের অফিস রয়েছে ঢাকায়। তারাও অর্ডার সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ক্রেতাদের মূল প্রতিষ্ঠানকে জানাচ্ছে।
ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের জোগান দিতে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। গত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন ৮-৯ হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। গত জুন-জুলাইয়ে গড়ে এর পরিমাণ ছিল ৬-৭ হাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা এখন তৈরি পোশাক রফতানির। পোশাক সংশ্লিষ্ট কাঁচামালও আমদানি হচ্ছে বেশি।

বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের সাড়ে ৮৩ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চলতি অর্থবছরে পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে জুলাই মাসে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৮১ কোটি ডলার। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে ৩০২ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি এবং গত অর্থবছরের জুলাইয়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। যেভাবে পোশাক জাহাজীকরণ হচ্ছে এতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেও পোশাক রফতানি বাড়বে বলে আশাবাদ উদ্যোক্তাদের।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি এবং এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নির্বাচন নির্বাচনের মতো হবে। ব্যবসা চলবে ব্যবসার মতো। আমরা এমনটি মনে করলেও বিদেশি ক্রেতারা সেটি মনে করেন না। এ মুহূর্তে ক্রেতারা শঙ্কিত। ফলে আগামী ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা বাংলাদেশে পোশাকের কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়ে ‘ধীরে চল নীতিতে’ হাঁটতে শুরু করেছেন। এর ফলে সামার সিজন বা গ্রীষ্মকালীন পোশাক রফতানি আদেশ কম হচ্ছে। পাশাপাশি একই কারণে ইতঃপূর্বে ক্রেতাদের দেয়া শীতকালীন পোশাকের অর্ডারের সরবরাহও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে শিপমেন্ট করার চাপ দিচ্ছেন। ফলে সরবরাহ সচল রাখতে মালিক, শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপক সবারই বাড়তি চাপ যাচ্ছে।

বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, রফতানিকারকরা সব সময় চ্যালেঞ্জের মধ্যেই থাকেন। তাই নির্বাচন ঘিরে দেশীয় প্রেক্ষাপটে বাড়তি কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছি না। দেশে সে ধরনের পরিস্থিতিও নেই। কিন্তু এটা ঠিক, বায়াররা সাধারণত নির্বাচনকালীন মুহূর্তগুলোয় খুব সতর্ক থাকেন। তারা ভেবেচিন্তে অর্ডার দেন। ফলে আগের ধারাবাহিকতায় এ সময়ে কিছুটা ছেদ পড়ে। তবে সেটি সাময়িক। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর তা বাড়তি অর্ডারের মাধ্যমে আবার পূরণও করে নেয়া হয়। তবে কারখানাগুলোয় এখন যে চাপ আছে, সেটি বায়ারদের শীতকালীন অর্ডার নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ দেয়ার জন্য।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রায় সব জাতীয় নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপ্তত্ত হয়েছে। এতে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে এবং ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বেশ উত্তপ্ত। ১৯৯১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হলেও এর আগে ৯০ সালের শেষদিকে আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯৫ সালেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়েই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে সংবিধানের আওতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একই বছরের ১১ জুন আবার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় শান্তিপূর্ণভাবে। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনের আগে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলেও ২০০৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০৫ সাল থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেনা সমথর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে-পরেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বেশ উত্তপ্ত।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version