এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যশস্য খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বর্তমান সরকার। কিন্তু এ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির চাল ও আটা মিলেমিশে পাচার করেছেন খোদ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ২ মাসে প্রায় প্রতিদিনই কমপক্ষে ৩৩৩ টন খাদ্যশস্য (৬০ দিনে ১৯৯৮০ টন) খোলা বাজারে বিক্রি না করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় পাচার করা হয়েছে। তেজগাঁও সরকারি খাদ্যগুদাম (সিএসডি) থেকে রাতের আঁধারে এগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যদিও ওএমএস’র খাদ্যশস্য গুদাম থেকে সকালে ট্রাকে ভরে সারা দিন নির্ধারিত স্থানে বিক্রি করার কথা।
পাচারের এ ঘটনায় সিএসডির ম্যানেজার থেকে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মীর অনেকে জড়িত বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে র্যাবসংশ্লিষ্টরা। তাদের ধারণা, এসব খাদ্যশস্য এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করলে অনেক রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে আসতে পারে। এরই মধ্যে একটি তালিকা তৈরি করে অনুসন্ধান শুরু করেছে র্যাব।
ওএমএস’র খাদ্যশস্য পাচারের ঘটনায় খাদ্য অধিদফতরের পরিচালক (সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন) পরিমল চন্দ্র সরকারকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক তপন কুমার দাস ও অধিদফতরের উপ-পরিচালক আফিফ আল মাহমুদ। অধিদফতরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) একেএম ফজলুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে রোববার এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
র্যাব সূত্র জানায়, শনিবার রাতে তেজগাঁওয়ের কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদাম (সিএসডি) থেকে পাচার হওয়ার সময় আট ট্রাক ভর্তি ১১৫ টন চাল ও আটা জব্দ করে র্যাব। তাৎক্ষণিকভাবে সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির এবং গুদাম ইনচার্জ মনিয়ার হোসেনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ২০ ঘণ্টা পর রোববার রাত ৮টার দিকে মুচলেকা নিয়ে তাদের খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। ওই দুই কর্মকর্তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কৃষি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ১১টি আড়ত থেকে ওএমএস’র আরও ১০০ টন চাল ও আটা জব্দ করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্বদানকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেন, ঢাকার ১৪১টি পয়েন্টে ১৪১টি ট্রাকে করে প্রতিদিন ১৪১ টন চাল এবং ২৮২ টন গম খোলা বাজারে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়ার কথা। অথচ খোলা বাজারে বিক্রি হতো খুবই অল্প পরিমাণে খাদ্যপণ্য। এগুলো রাতের আঁধারে ট্রাকে করে বিভিন্ন জেলায় চলে যেত। শনিবার রাতে জব্দ হওয়া ট্রাকগুলো গাজীপুর, শ্রীমঙ্গল এবং চুয়াডাঙ্গা জেলায় যাওয়ার কথা ছিল। অপরদিকে খোলা বাজারে বিক্রির জন্য যেগুলো দিনে বের হয় এর একটি অংশ চলে যায় মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ওএমএস’র পণ্য পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। এখনও র্যাব তাদের কার্যক্রম শেষ করেনি। তাদের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর দৃশ্যমান তদন্ত শুরু হবে।
তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা সিএসডির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সরেজমিন পরিদর্শন করে কথা বলেছেন। পণ্য পাচারের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। র্যাব তাদের কার্যক্রম শেষ করুক। তারপর দেখেন আমরা কী ব্যবস্থা নেই। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না।
প্রতিদিন সকালে সিএসডিতে ১৪১ ট্রাকের পরিবর্তে ঢুকত ৩০টি : র্যাবের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১০ সাল থেকে সরকার নিু আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি (ওএমএস) করছে। সরকারের ওএমএস কার্যক্রমের ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে খাদ্যশস্য কিনতে পারেন। প্রতিদিন রাজধানীর ১৪১টি পয়েন্টে এ কার্যক্রম চলার কথা। ২ সপ্তাহ ধরে মনিটরিং করে দেখা গেছে, এ কার্যক্রম চলছে দায়সারাভাবে। ১৪১টি পয়েন্টে পণ্য বিক্রি করার জন্য গুদামে প্রতিদিন সকালে ১৪১টি ট্রাক আসার কথা। প্রতি ট্রাকে এক টন চাল এবং দুই টন আটা বিক্রি হওয়ার কথা। এ হিসাবে প্রতিদিন বিক্রি হবে ৪২৩ টন খাদ্যশস্য। অথচ প্রতিদিন সকালে মাত্র ৩০টি ট্রাক এসে ওএমএসের পণ্য নিয়ে যেত। অর্থাৎ মাত্র ৯০ টন বিক্রি হতো। বাকি ৩৩৩ টন রাতের আঁধারে পাচার করা হতো। দীর্ঘদিন ধরে এ অনিয়ম হচ্ছিল সিএসডিতে। গত ২ মাসে এ অনিয়মের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
সিএসডির ম্যানেজার থেকে দারোয়ান পর্যন্ত জড়িত : র্যাবের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন জেলা এবং রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে ওএসডি’র পণ্য পৌঁছানোর পুরো কাজ নিজেই তদারকি করেন সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির। পুরো প্রক্রিয়ায় ম্যানেজার থেকে শুরু করে নিরাপত্তা কর্মীর অনেকে সরাসরি জড়িত। দেশের বিভিন্ন জেলায় ওএসডির পণ্য ট্রাকে করে যায়। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে যায় পিকআপ ভ্যানে।
র্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- অভিযান, গোয়েন্দা তথ্য এবং জব্দ পণ্যের বিষয়গুলো বিস্তারিত উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি প্রতিবেদন দেয়া হবে। তারা তদন্ত করে পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
এ বিষয়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেন, ওএমএস’র খাদ্যপণ্য পাচারে সিএসডির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরাসরি সম্পৃক্ত। এর বাইরে আরও অনেকেই জড়িত রয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখবে।
সিএসডির ম্যানেজারের বক্তব্য : এদিকে রোববার ভোরে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অভিযানের সময় সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির বলেন, গাড়িগুলো আমি লোড করি না। সিএসডি থেকে ট্রাকে করে খাদ্যপণ্য কীভাবে বের হল, আমি বলতে পারব না।
সিএসডিতে কখন কী হচ্ছে, তা মনিটরিং করার দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, কীভাবে বের হল, তদন্ত করে দেখা হবে।
র্যাবের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বিভিন্ন সেকশনের কর্মকর্তা আছেন, কর্মচারী আছেন। তাদের মাধ্যমেই গোডাউন থেকে ট্রাকে খাদ্যপণ্য বের হয়।
এ সময় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবিরকে উদ্দেশ করে বলেন, খোলা বাজারে বিক্রির জন্য একটি ট্রাকে এক টন চাল এবং দুই টন আটা যাওয়ার কথা। কিন্তু জব্দ করা প্রতিটি ট্রাকে ৬-৭ টন মাল লোড করে পাচার হচ্ছে। এর দায় আপনি এড়াতে পারেন না।
এ সময় সিএসডির ম্যানেজার হুমায়ুন কবির জি স্যার, জি স্যার বলে চুপ থাকেন।
মোহাম্মদপুরের ১১ আড়তে অভিযান : মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে রোববার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। অভিযানে গিয়ে র্যাব দেখতে পায়, সরকারি খাদ্যগুদামের লোগো এবং সিল সংবলিত চাল এবং আটার বস্তা বিভিন্ন আড়তে রাখা আছে। অভিযানে ১১টি আড়ত থেকে ১০০ টন চাল এবং আটা উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে রহমানিয়া রাইস এজেন্সি থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৪৭ বস্তা চাল, কর্ণফুলী রাইস এজেন্সি থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৭৫ বস্তা চাল, এশিয়ান ট্রেডার্স থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৮০ বস্তা চাল, বঙ্গ রাইস এজেন্সি থেকে ২০ কেজি ওজনের ৫৭৯ বস্তা চাল, জামি ট্রেডার্স থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৩০০ বস্তা চাল, জননী ট্রেডার্স থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৮৫ বস্তা আটা, সুগন্ধা-১ থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৭৫ বস্তা আটা, সুগন্ধা-১ থেকে ৫০ কেজি ওজনের ৩০ বস্তা আটা, মহানগর ট্রেডার্স থেকে ৫০ কেজি ওজনের ১২ বস্তা আটা এবং সূর্য এন্টারপ্রাইজ থেকে ৩০ কেজি ওজনের ৫৮ বস্তা আটা জব্দ করা হয়। অভিযানের সময় এসব আড়তের মালিক উপস্থিত ছিলেন না।
অভিযানের বিষয়ে মোহাম্মদপুর সরকারি কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ আনিছুর রহমান বলেন, এ মার্কেটটি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কখনোই জড়িত ছিলেন না। তবে সম্প্রতি এ মার্কেটে রাতের আঁধারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওএমএস’র পণ্য ঢুকাচ্ছেন। পিকআপ দিয়ে তারা এগুলো আনছেন। আমরা চাই, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়।