এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ড. কামাল হোসেন। বাংলাদেশ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা। মুক্তিযোদ্ধা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রবীণ আইনজীবী। গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। রাজনীতিতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সংবিধান সম্মতভাবে দেশ পরিচালনার দাবিতে তিনি বরাবরই সোচ্চার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চলমান নানা অনিশ্চয়তা-সংশয়ে তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

বৃহত্তর ঐক্য নিয়ে কাজ করছেন। এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, আগামী নির্বাচনসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দৈনিক মানবজমিন-এর সঙ্গে কথা বলেছেন।

একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, দেশের বর্তমান অবস্থা তো সবাই দেখতে পাচ্ছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার পরিস্থিতির করুণ দশা। মানুষ চায় শান্তি। আইনের শাসন। হানাহানি নয়। একটি নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সবাই চায়। এ বিষয়ে তো কারো মধ্যে মতবিরোধ নেই। সেই জায়গায় তো সবার ঐকমত্য রয়েছে। তাছাড়া জাতীয় সংকটে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়। আমরা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলছি। প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এখন ঐক্যের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা আ স ম আবদুর রবের বাসায় বসেছিলাম। সেখানে বি. চৌধুরী, মান্নাসহ অনেকে বসেন। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঐক্যের ঘোষণা হবে। আমার সঙ্গে সরাসরি কথা না হলেও বিএনপি এ ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রতি ইতিবাচক বলে জানা গেছে। ঐক্যের পরিধি বাড়ছে। বৃহত্তর ঐক্যের দিকে যাচ্ছি। শুধু রাজনীতিবিদ নয়। পেশাজীবী, ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে আসুন।

এক প্রশ্নের উত্তরে ড. কামাল বলেন, সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায়। বিএনপিও তো একবার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করেছিল। আমরা কী মেনে নিয়েছি। নির্বাচন করতে হবে তো প্রহরী হয়ে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে কী নিরপেক্ষ হয়? বৃটেনসহ কোনো কোনো দেশে সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে। তাদের অবস্থা ওই স্তরে চলে গেছে যে, তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ তোলে না। তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা তো ভিন্ন। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার তো নিজেই মন্তব্য করেছেন যে, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকার বলছে তার তা বলা উচিত হয়নি। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের পক্ষ নিতে বাধ্য করছে। স্থানীয় নির্বাচনগুলো কী নিরপেক্ষ হয়েছে। তাহলে জাতীয় নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ হবে। তখনকার ঘটনাগুলো দেখুন। পত্রপত্রিকা দেখুন নির্বাচনের নামে কী হয়েছে? তাহলে ভবিষ্যৎ কী হবে? এসব সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে আমরা ঐক্যের আবেদন রাখছি। এ ঐক্য শুধু নিরপেক্ষ নির্বাচন নয়। নির্বাচন-পরবর্তী আইনের শাসন বজায় রাখার জন্যও কাজ করবে।

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার কী করতে চায় তা তো বিভিন্ন ঘটনা দেখে বোঝা যায়। নির্বাচনগুলোর চিত্র লক্ষ্য করুন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। এখন সহজে সব কথা বলতে পারছে না। কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ রেহাই পেয়ে এলেও ভয়ে মুখ খুলছে না। সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে। এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন- শান্তি, স্থিতিশীলতা, দেশ গড়ার পরিবেশ, পড়াশোনার পরিবেশ, তরুণদের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি বজায় রাখতে হবে। ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা কী। চিত্র এর বিপরীত। তবে ইতিবাচক কথা হলো- সংবিধান এখনো বলবত আছে। সংবিধানের চার মূলনীতির একটি হলো গণতন্ত্র। এখনো সবাই সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তারপরও ঘাটতি হচ্ছে কেন।

আমরা কিছু করতে পারছি না কেন। তার উত্তর হচ্ছে- সুষ্ঠু রাজনীতি হচ্ছে না বলে। ঐকমত্য গড়ে তুলে আমরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু তা ধ্বংস করা হয়েছে। রুগ্ন রাজনীতির কারণে তা সংবিধান অনুযায়ী চলছে না। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আমরা সবাই তাই চাই।

দেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মানবাধিকার তো লঙ্ঘন হচ্ছেই। যারা সরকারে থাকে তাদের তো ক্ষমতা, পুলিশ, বিডিআর, আর্মি আছে। তারা কেন মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে। আর কারা লঙ্ঘন করছে। দেখেন সরকারি দলের ভূমিকা। বিনা ওয়ারেন্টে- অপরাধে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থানায় কয়েকদিন রেখে দিচ্ছে। নিখোঁজ হচ্ছে, গুম হচ্ছে। মানবাধিকারের বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট বিধান রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ভিত্তিতে মানুষের মানবিক অধিকার রক্ষার বিধান রয়েছে। কার্যকরের বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার কমিশনও আছে। এখন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করুন তারা আইন অনুযায়ী তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে কিনা। মাঠে-ময়দানে যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। কারা পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে লাঠিয়ালের দায়িত্ব পালন করছে। দেখুন তারা কী বলে। সরকার, পুলিশ ও মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব তো আছে। আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা না পেলে তার প্রতিকারও পেয়েছে কিনা। দেশের অবস্থা দেখুন। সংবিধান মেনে সবাই দায়িত্ব পালন করছে কি-না দেখুন।

তিনি তার ঐক্যের লক্ষ্য সম্পর্কে বলেন, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই ঐক্য প্রক্রিয়ার লক্ষ্য শেষ হয়ে যাবে না। বরং নির্বাচনের পর সাংবিধানিক শাসনকে অর্থপূর্ণভাবে কার্যকর করা। বাস্তব অবস্থা থেকে মূল্যায়ন করে সে দিকে যেতে চাই। শান্তি-শৃঙ্খলা চাই। যাতে সরকার সংবিধানকে রক্ষা করবে। শপথের প্রতি শ্রদ্ধা রাখবে। দলীয় প্রভাব থেকে প্রশাসনকে মুক্ত রাখবে।

দেশের দুর্নীতির নানা চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, এখনকার দুর্নীতি তো এরশাদের সময়কালকেও হার মানাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তো বললেন, চার হাজার কোটি টাকা- টাকাই না। এক বিদেশি আমাকে ওই চার হাজার কোটি টাকাকে ডলারে হিসাব করে বলেছিলেন, এত মিলিয়ন ডলার যদি ডলারই না হয় তোমাদের দেশে তাহলে কত ডলারকে তোমরা ডলার বলবে? কারণ ওই ডলার তাদের কাছেও অনেক টাকার সমান।

সবশেষে পাঠকদের উদ্দেশে ড. কামাল বলেন, পাঠকরা দেশের নাগরিক। দেশের নাগরিকরাই দেশের মালিক। মালিক হিসেবে তাদের দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে। সবাইকে সজাগ হতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তখন সরকার বুঝতে বাধ্য হবে। সূত্র : মানবজমিন

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version