এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ভোটের অধিকার আদায়ে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টির অঙ্গীকার করেছেন বিএনপি, ঐক্যপ্রক্রিয়া এবং যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। একমঞ্চ থেকে তারা দুর্নীতিমুক্ত আগামী দিনের বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ নেন। এর মাধ্যমে শুরু হল বড় ঐক্যের আনুষ্ঠানিক যাত্রা।
একই সঙ্গে তারা খুন-গুম চিরতরে বন্ধ করে আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেন। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের জন্য সমাবেশ থেকে আহ্বান জানানো হয়।
নেতারা এ সময় ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ১ অক্টোবর থেকে দেশব্যাপী ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ ব্যানারে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ারও ঘোষণা দেন।
সমাবেশ থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সারা দেশের জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন-ওয়ার্ডে সব শ্রেণী-পেশার নাগরিককে নিয়ে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ গণজাগরণের কর্মসূচি অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধের দাবি জানানো হয়।
শনিবার রাজধানীর গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া আয়োজিত নাগরিক সমাবেশ থেকে এ আহ্বান জানানো হয়। ‘কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন’ শীর্ষক সমাবেশের আয়োজন করে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া। বিশিষ্ট আইনজীবী, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এতে সভাপতিত্ব করেন।
প্রধান অতিথি ছিলেন যুক্তফ্রন্টের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মহানগর নাট্যমঞ্চে বিকাল ৩টার দিকে শুরু হয় নাগরিক সমাবেশ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির চার শীর্ষ নেতা সমাবেশে যোগ দেন। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় উপস্থিত হন সমাবেশের প্রধান অতিথি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
এ সময় হাতে হাত রেখে ঐক্যের ঘোষণা দেন সমাবেশে অংশ নেয়া বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট এবং জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতারা। সমাবেশ শুরুর আগে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হলে নাগরিক সমাবেশ কার্যত জনসভায় পরিণত হয়।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় দশ ইস্যুতে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে এর জবাব চান অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যে স্বাধীনতা আনতে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, মা-বোনকে ইজ্জত দিতে হয়েছে- তার মূল্যবোধ আজ কেন পদদলিত? দিনরাত প্রতিটি ঘণ্টা নিয়ে মা-বোনেরা কেন আতঙ্কে থাকবেন, শঙ্কায় থাকবেন গুম-রাহাজানি নিয়ে। কেন পুলিশ, র্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের ছাড় দিবে? কেন ঘুষ দুর্নীতিকে ‘স্পিড মানি’ বলে সরকারিকরণ করা হল? সমস্ত জাতির নৈতিকতাবোধকে পদদলিত করা হল? এই অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের?’
সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে কঁচি-কিশোরদের রাস্তায় নামতে হবে কেন? কেন কোটা সংস্কারের পক্ষে আমাদের আদরের মেধাবী ছাত্রদের আন্দোলন করতে হবে? মেধাবী ছাত্রদের কী অপরাধ? কেন তাদের গুণ্ডা দিয়ে, হাতুড়ি দিয়ে, চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করা হবে, এর জন্যই কি স্বাধীনতা? কেন আপনাদের অপরাধের কথা বলার জন্য সভা-সমাবেশ করতে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে? অথচ আপনারা যখন, সেখানে সেখানে সভা সমাবেশ করতে পারেন। কেন, কেন?’
সাবেক এই রাষ্ট্রপতি আরও প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কেন আমার ভোট আমি দিতে পারব না? ভোটের অধিকারকে কেন দলীয়করণ করা হল? সারা পৃথিবীতে ইভিএম পরিত্যক্ত। ইভিএম কেউ চায় না। কেন আপনাদের সুবিধার জন্য ইভিএম গ্রহণ করতে হবে? কেন সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণ করা হল? কেন তাদের সবসময় ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হচ্ছে? কেন স্বাধীন দেশের মা-বোন ও শিশুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে? আমাদের রাষ্ট্র তুমি কোথায়? আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গী বন্ধু রাষ্ট্র কোথায়? কেন গঙ্গার পানি পাব না, কেন বন্ধু রাষ্ট্র তিস্তার পানি দেবে না? এখন রুখে দাঁড়ানোর সময়, এখন অধিকার আদায়ের সময়। প্রতিবাদের কণ্ঠ ধারালো করতে হবে।’
যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান বলেন, ‘আজ আমাদের গণতন্ত্রের সপক্ষ ও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল এবং আছে- তাদের সঙ্গে ঐক্য করব না। একটি স্বেচ্ছাচারী, গণতন্ত্রবিরোধী সরকার গত ১০ বছরে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, এমনি আবারও একটি অনুরূপ সরকারের ঝুঁকি আমরা নিতে পারি কি? সংসদে, মন্ত্রিসভায়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করতেই হবে। না হলে স্বেচ্ছাচারমুক্ত বাংলাদেশের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করা যাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইভিএম ছুড়ে ফেলতে হবে। ভোট কেন্দ্রে সিসিটিভি লাগাতে হবে। পুলিশ-র্যাব আমাদের সন্তান। তাদের বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। যারা গুম-খুন হত্যা করেছেন, তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আজ এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই যেখানে দুর্নীতি, ঘুষ হয় না। গত ছয় মাস ধরে প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে আসছি, এসব কেন? তিনি জবাব দিতে পারেননি। স্বাধীন দেশে কেন সভা সমাবেশের অনুমতি নিতে হবে? আমরা জনগণের অনুমতি নিয়েই সভা-সমাবেশ করব, কারও তোয়াক্কা করব না।’
সরকারের উদ্দেশে ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘১০ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন, দেশে গণতন্ত্র আইনের শাসন নেই। কেন? গণতন্ত্র হত্যা করেছেন কেন? বলছেন, ভারত বন্ধু রাষ্ট্র। আমরাও মনে করি। কিন্তু তিস্তা-গঙ্গার পানি পাইনি। কেন- এটা ভারত সরকারকে বলতে হবে।’ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ফেরত দিয়ে সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের বক্তব্য আপনাদেরই ফেরত দিতে হয়, রাবিশ।’
বিশিষ্ট আইনজীবী, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সূচনা বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের মানুষ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। আজ তা পুনরুদ্ধারে আমরা সমবেত হয়েছি। একাত্তর সালে ?মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আজ জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিও হচ্ছে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; রাষ্ট্রের আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমি আশা করি, মঞ্চে উপবিষ্ট জাতীয় নেতারা জনগণকে উজ্জীবিত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ও গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে জনগণকে অনুপ্রাণিত করে তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখবেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ সুশাসন চায়। গণতন্ত্র চায়। আইনের শাসন চায়। স্বৈরশাসনের অবসান চায়। ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। মুক্ত এবং স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘দেশের জনগণের চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। তাই তারা দিশেহারা। দেশের জনগণ সুশাসন দেখতে চায়, একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সমাজ নিশ্চিত করতে চায়। কার্যকর গণতন্ত্র ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন দেখতে চায়।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘মানুষ পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়ায়, কিন্তু ন্যায্য দাম পায় না। এদিকে দেশের হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে জনগণ সব ক্ষমতার মালিক। কিন্তু আজকে দেশের মানুষ ভোটের অধিকার, মানবাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এসব অধিকার পুনরায় উদ্ধার করতে হলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমি আশা করব, আজ যারা এই নাগরিক সমাবেশে এসেছেন তারা জনগণের এসব অধিকার নিয়ে কথা বলবেন এবং কাজ করবেন।’
প্রবীণ আইনজীবী আরও বলেন, ‘কেউ কেউ আমাদের এই ঐক্যের প্রচেষ্টাকে ক্ষমতায় যাওয়ার ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। আমরা প্রকাশ্যে সভা করছি, কোনো গোপন বৈঠক করছি না। যারা জনগণের শক্তিকে ভয় পায়, তারা জনগণের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টাকে ষড়যন্ত্র বলে জনগণকেই অপমান করছে’।
তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাকে সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এটা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমার চাওয়া-পাওয়া বলতে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী জনগণের ক্ষমতায়ন- একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার পবিত্র কর্তব্য’।
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা জনগণের ভোটাধিকারসহ মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। জনগণ তাতে ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। মৌলিক বিষয়ে মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। এখন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার সময় এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রচেষ্টা সফল হবে ইনশাআল্লাহ’।
এ সময় নেতাকর্মীসহ সবার উদ্দেশে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আপনারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। মুক্তির বার্তা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করুন। অতীতে জনগণের বিজয়কে কেউ ঠেকাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকে সবাই একটি কারণে উপস্থিত হয়েছেন, সবাই এই সরকারের পরিবর্তন দেখতে চান। খালেদা জিয়ার মুক্তি দিতে হবে। যিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন, তাকে আজ অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলে গিয়েছিলেন আগে দেশকে বাঁচাতে হলে, মানুষকে বাঁচাতে হলে- এই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে জাতীয় ঐক্য ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তিনি আরও বলেছিলেন, সব দলমত নির্বিশেষে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি সবাই এক হয়ে স্বৈরাচার- যারা মানুষের বুকে পাথর চাপা দিয়ে বসে আছে তাকে সরাতে হবে। এজন্য জনগণের ঐক্যই হচ্ছে একমাত্র বিকল্প, অন্য কোনো বিকল্প নেই’।
তিনি আরও বলেন, ‘আজকে সব বক্তাই পরিষ্কার করে বলেছেন, দেশে এখন দুঃশাসন চলছে। এই দুঃশাসন আমাদের স্বাধীনতার সব স্বপ্নকে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে। আমাদের আশা-আকাক্সক্ষাকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে। আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করব, সবার সমান অধিকার নিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরি হবে। সেই দেশটাকে এখন তারা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য নীলনকশা করছে’।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে একটা স্যাঁতসেঁতে পরিত্যক্ত নির্জন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। তার সুচিকিৎসা হচ্ছে না। মৌলিক অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তারপরও তিনি কারাগার থেকে খবর পাঠিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য তৈরি করে এই দুঃশাসনকে সরাতে হবে। গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে’।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আজকে এই গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। বিএনপির ৫’শর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলা নতুন করে দেয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে ৭৮ হাজার মামলা দেয়া হয়েছিল। এই ১৮ দিনে মামলার সংখ্যা হচ্ছে ৩ হাজার ৭৭৬, এজাহার দেয়া হয়েছে ৭৮ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। যেখানে অজ্ঞাত নামে মামলা দেয়া হয়েছে ৩ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ঘরে ঘরে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাই- আন্দোলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা। আগামী নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারে। জনগণকে দূরে রাখার জন্যই এই নতুন করে মামলা দেয়া তারা শুরু করেছে’।
তিনি বলেন, ‘আজ এই সরকারকে যদি আমরা সরিয়ে দিতে না পারি, জনগণের সরকার যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, জনগণের ঐক্যের সরকার যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তাহলে এই দেশের স্বাধীনতা থাকবে না। জনগণ তাদের অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হবে। সেজন্য আজ সব দলের দাবি প্রায় একই। যেখানে প্রধান শর্ত হচ্ছে তফসিলের আগে এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। ইভিএম পদ্ধতি কোনোমতেই এই নির্বাচনে প্রয়োগ করা যাবে না’।
বিএনপি মহাসচিব সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন আমরা ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করি। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে এই সরকারকে বাধ্য করব। একই সঙ্গে সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এছাড়া সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে এ সরকারকে বাধ্য করতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ সভার মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে আমরা একধাপ এগিয়ে গেছি। বাকিটুকু দ্রুত অর্জনের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাব।
দেশের মানচিত্র লুট হয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আজ গুম, খুন, অপহরণ, বেওয়ারিশ লাশের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে এক টাকার উন্নয়ন হয়েছে, আবার একশ’ টাকা লুটও হয়েছে। ব্যাংকের টাকা লুট হচ্ছে। শেয়ারবাজার লুট হচ্ছে। কয়লা খনি থেকে কয়লা উধাও হয়ে যাচ্ছে। কবে যে দেশের মানচিত্র লুট হয়ে যায়, সেই আতঙ্কে রয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, সরকার দেশ রক্ষায় নয়, তারা অন্য কাজে ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে জেএসডি সভাপতি বলেন, ‘আপনি সংসদ ভেঙে দিন, নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে আমাদের ঐক্যে চলে আসুন। আপনি জিতলে আমরা মেনে নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মাঠে নামব দেশ থেকে স্বৈরাচার হঠাতে। এর জন্য জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে বন্দি করে রাখা হচ্ছে। আমরা রাজপথে নামলে কাউতে বন্দি রাখতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুক্তির দাবি জানিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দেশ আজ গভীর সংকটে। নির্বাচনের বাকি মাত্র তিন মাস। এ সময়ও সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবারও সাড়ে ৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাম দলের নেতাদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে। আমি বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক দলের আটক নেতাদের মুক্তি চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমরা ভোট দিতে পারব না। ভোট দিতে পারলেও সঠিকভাবে ভোট গণনা হবে না।’ আওয়ামী লীগ সরকারকে চোর, লুটেরা ও ডাকাত অভিহিত করে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বলেন, এ সরকারের সময় ব্যাংকগুলোতে সোনাও তামা হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, মামলা হয়েছে আড়াই কোটি টাকার জন্য খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ চোর, লুটেরা, ডাকাত। ওরা ব্যাংকের টাকা চুরি করে। এই চোরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্ষমতা থেকে হঠাতে হবে।
তিনি বলেন, ‘কারও ক্ষমতা নেই, এ ঐক্য রুখতে পারে। আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য করব।’ মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, ‘এই সং মার্কা সংসদ দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করলে চলবে না। এ নির্বাচন কমিশন দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করা চলবে না। নির্বাচনের আগে জনগণকে নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সারা দেশে আমরা যাব ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে। লাখো-কোটি মানুষকে নিয়ে এক দফার দাবি নিয়ে মাঠে নামব।’
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াই প্রথম জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আজ এ প্লাটফর্ম থেকে জাতীয় ঐক্যের শুরু হল। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’
জাতীয় ঐক্যের উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, এই স্বৈরাচারকে সরাতে জাতীয় ঐক্য ছাড়া সম্ভব নয়। এটা মাইলফলক, নতুন যাত্রা শুরু হল। এ সময় তিনি জাতীয় ঐক্যের ৫ দফাকে সমর্থন করে দলীয় দুই দফা যোগ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। সব রাজবন্দিকেও মুক্তি দিতে হবে। জাতীয় ঐক্যের নেতাদের বলব, আপনারা কাজ করুন, আমরা আপনাদের পাশে আছি।’
জাতীয় ঐক্যের সাফল্য কামনা করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, ‘ড. কামালের নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তার সাফল্য কামনা করি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকারের জন্য কেন আজ আন্দোলন করতে হবে। এটা খুবই লজ্জাকর। এই ঐক্য প্রক্রিয়া গণতন্ত্রকে সাহস জোগাবে।’
ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, ‘এই জাতীয় ঐক্য হবে দলে দলে নয়, নেতায় নেতায় নয়, ঘরে ঘরে, জনে জনে।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যমান অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ সময় তিনি যুক্তফ্রন্টের পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন।’
গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘দেশে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জামায়াতসহ ’৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারবে না।’
আলোচনায় অংশ নেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. মঈন খান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ও গণফোরাম নেতা সাইদুর রহমান। সভা পরিচালনা করেন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সচিব ও ফরোয়ার্ড পার্টির সভাপতি আ ব ম মোস্তফা আমিন। আলোচনা শেষে সমাবেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তেল গ্যাস খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
সমাবেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, আহসান হাবিব লিংকন, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, খেলাফত মজলিসের মাওলানা মজিবুর রহমান, আহমেদ আবদুল কাদের, এনপিপির ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাগপার খোন্দকার লুৎফর রহমান, আসাদুর রহমান খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।