এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল এবং ডিসেম্বরের শেষদিকে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়। ওই সময়সীমা অনুযায়ী ভোটের রোডম্যাপ (প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা) চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে ইসি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো গোপনীয়তার সঙ্গে আলাদাভাবে নিজ দফতরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে।

এতে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ কখন ও কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এরপর তা একীভূত করে অনুমোদন করবে কমিশন। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ভোটের কর্মপরিকল্পনা দ্রুত শেষ করতে ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। ইসির হিসাব অনুযায়ী, আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগননা শুরু হচ্ছে। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘বড়দিন’। ওই দিনের খুব কাছাকাছি সময়ে ভোট গ্রহণ না করার জন্য খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে ইসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সংস্থা আসে। বড়দিনের কাছাকাছি সময়ে ভোট গ্রহণের তারিখ হলে তাদের জন্য সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছে ইসি সচিবালয়।

সূত্র জানায়, প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এক বা একাধিকবার বৈঠক করবে ইসি। তবে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসার কোনো পরিকল্পনা নেই কমিশনের। এছাড়া গত দশম সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও একইভাবে ভোটের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনা (সশস্ত্র) বাহিনীর সদস্যদের রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ব্রিফিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। এছাড়া মাঠ প্রশাসনকে উজ্জীবিত করা ও নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জেলা প্রশাসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন সিইসি। এরই অংশ হিসেবে সিইসি দিনাজপুর ও বগুড়া সফরে বেরিয়েছেন।

ভোটের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে ভোটার তালিকার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

নির্বাচনের সামগ্রী কেনার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। ভোট কেন্দ্রের খসড়া তালিকাও প্রকাশ করা হয়েছে। ইসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বর্তমানে সিইসি ও ইসি সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কর্মপরিকল্পনা তৈরির কাজ করছেন।

তবে পাঁচ কমিশনারের মধ্যে দূরত্বের কারণে নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত পরিকল্পনা সাজানোসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন কর্মকর্তারা। কমিশনারদের মধ্যে এমন বিরোধপূর্ণ অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, আমাদের (নির্বাচন কমিশনারগণ) মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের মধ্যে দূরত্ব নেই।

ইসি সূত্র জানায়, সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন।

এ সময়সীমার মধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করে আনছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী চূড়ান্ত না হওয়ায় ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত বিধিমালা চূড়ান্ত ও নির্বাচনী ম্যানুয়েল তৈরি করতে পারছে না কমিশন।

এ আইন সংশোধন হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। যদিও নির্বাচন কমিশনের সংলাপে জাতীয় নির্বাচনে এ মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত দেয় বেশির ভাগ দল। প্রসঙ্গত, সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ ১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল।

ইসির নির্বাচনী প্রস্তুতি : ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, আইন ও বিধিমালা সময়োপযোগী করার প্রয়োজন হয়। এগুলো শেষ পর্যায়ে।

এছাড়া নির্বাচনী সামগ্রী বহনের জন্য পাটের ব্যাগ, অমোচনীয় কালি, বিভিন্ন ধরনের সিলসহ নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় করা, মনোনয়ন ফরমসহ বিভিন্ন প্রকার ফরম ও প্যাকেট মুদ্রণ এবং নির্বাচনী ব্যয়ের বাজেট প্রণয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করতে হয়। তফসিল ঘোষণার পর ব্যালট মুদ্রণ, যাচাই-বাছাই ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়।

কমিশন কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহে ভোটার তালিকা প্রিন্টিংয়ের কাজ শুরু হবে। নির্বাচনী সামগ্রীর মধ্যে গানিব্যাগ ও হেসিয়ান ব্যাগ সরকারি সংস্থা বিজেএমসি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। স্ট্যাম্প প্যাড, সিলগালা, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল ও অমোচনীয় কালি সংগ্রহে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। অক্টোবর মাসের মধ্যে এসব সামগ্রী ইসির ভাণ্ডারে পৌঁছবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এছাড়া গত এপ্রিলে ২৫টি আসনের সীমানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে ইসি। এ নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। এতে নতুন কোনো দল নিবন্ধন পায়নি। নিবন্ধন দেয়া হয়েছে ১১৯টি দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে।

ভোট কেন্দ্র চূড়ান্ত : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭১ উপেক্ষা করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র চূড়ান্তের আদেশ দিয়েছিল ইসি। ওই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সারা দেশে ভোট কেন্দ্র নির্ধারণ করার চিঠিও দিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে ইসি সচিবালয়ে বিতর্ক দেখা দিলে ওই আদেশ সংশোধন করে খসড়া ভোট কেন্দ্রের তালিকা করা হয়েছে।

এতে একাদশ জাতীয় সংসদে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪০ হাজার ১৯৯টি ও ভোটকক্ষ (বুথ) ২ লাখ ৬ হাজার ৫৪০টি। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৭০৭টি ও ভোটকক্ষ ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮টি।

ইসির এক কর্মকর্তা জানান, আরপিওর ধারা ৮ অনুযায়ী ভোট গ্রহণের ন্যূনতম ২৫ দিন আগে রিটার্নিং অফিসার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে। কিন্তু ইসি সচিবালয় ৬ সেপ্টেম্বরই চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্রের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এ সংক্রান্ত কার্যক্রমও গুছিয়ে আনে।

পরে আইনি চ্যালেঞ্জের আশঙ্কায় চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ থেকে সরে এসেছে কমিশন। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বিগত নির্বাচনগুলোতে ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভোট কেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি করে রাখতেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা ওই তালিকা থেকেই ভোট কেন্দ্র চূড়ান্ত করতেন।

চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্র প্রকাশের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমাকে দেখে ও বুঝে বলতে হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা নিজ স্বাক্ষরে চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্রের তালিকা পাঠাবেন। ইসি ওই তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কারা নিয়োগ পাবেন তা এখনও আলোচনা হয়নি।

প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা : জানা গেছে, আগামী ১ থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হবে এমন পরিকল্পনা নিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট। এরই অংশ হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগের ৫ দিনের মধ্যে ৬৭৫ জন রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মাস্টার ট্রেইনারদের অক্টোবরের শেষার্ধে ও নভেম্বরের শুরুতে প্রতি জেলা থেকে ৫ জন করে ম্যাজিস্ট্রেট প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এছাড়া ডিসেম্বরের শুরুতে ইলেকট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটি, মাঠ পর্যায়ের সাড়ে সাত হাজার পোলিং এজেন্ট এবং সাত লাখ ২৫ হাজার নির্বাচন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ শুরু হবে।

এ মাসেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪৬ হাজার সদস্যকে উপজেলাভিত্তিক ব্রিফিং বা প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা আছে ইসির। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version