এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সরকারি এবং বিরোধী উভয় জোটের লক্ষ্য অক্টোবর মাস। জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকার গঠনকে সামনে রেখে উভয় জোটই মরিয়া মাঠ দখলে। এর অংশ হিসেবে ক্ষমতাসীন জোট আগামী তিন মাস রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে।

বিএনপিও পুরো শক্তি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ড. কামাল হোসেন ও অধ্যাপক ডা. একিএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়াও অক্টোবরজুড়ে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ করবে। ওইসব সমাবেশে বিএনপি থাকতে পারে। কোনো পক্ষই ছাড় দিতে চাচ্ছে না। বুধবার রাজধানীতে পেশাজীবীদের সমাবেশ করেছে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া। শনিবার বিএনপি এবং ১৪ দল ঢাকায় পৃথক স্থানে সমাবেশ করবে।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওইদিন মাঠ দখলে নেয়ার ঘোষণা এসেছে। বিএনপি মাঠ দখলে নেয়ার ঘোষণা না দিলেও যে কোনো মূল্যে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনীতি আবারও সঙ্ঘাতপূর্ণ হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে জনমনে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সচেতন নাগরিকরাও বিষয়টি ইতিবাচক দেখছেন না। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা উভয় জোটকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, আগামী নির্বাচনের আগে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অবস্থান কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়। জাতীয় স্বার্থে দুই রাজনৈতিক জোটকেই ছাড় দিতে হবে। শীর্ষ নেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। ভোটারদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হবে। ভোট নিয়ে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা জন্ম হয়, যা নাশকতার দিকে বাঁক নিতে পারে।

এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা শুরু হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বন্ধ হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। এতে কর্মসংস্থান ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বেকারত্ব বাড়বে। অধিক বেকারত্ব সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি করে।

উল্লেখ্য, আগামী শনিবার বিকালে মহানগর নাট্যমঞ্চে সমাবেশ করবে ১৪ দল। একই সময়ে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে কোনো একটি স্থানে সমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। বিএনপির এই সমাবেশ কর্মসূচির দিকে ইঙ্গিত করে ইতিমধ্যে মঙ্গলবার ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রতিপক্ষকে মাঠে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নেতাকর্মীদের এলাকায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশের পাশাপাশি কোনো অপশক্তি যেন মাঠে নামতে না পারে সেই নির্দেশ দেন। রাস্তায় প্রতিহত করার নির্দেশও দেন তিনি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছে। বুধবার এ নিয়ে মুখ খুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

রাজবাড়ীর এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেবে না। তিনিও দলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, কাউকে রাজপথ দখল করে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। তবে আপনারা আগে কাউকে আক্রমণ করবেন না। কিন্তু যদি আপনাদের আক্রমণ করে, তার সমুচিত জবাব দেয়া হবে।

অপরদিকে বিএনপি শনিবার সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড়। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব বলেন, অনুমতি না দিলেও বিএনপি সমাবেশ করবে। তিনি অভিযোগ করেন, সমাবেশকে ঘিরে সরকার সঙ্ঘাত উসকে দিতে চায়। নাসিম সাহেব (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বলেছেন, অলিগলিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের আটকে দিতে। আর নানক সাহেব বলেছেন, হাত-পা ভেঙে দিতে। এই হচ্ছে তাদের গণতন্ত্রের ভাষা। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কারা শুরুতে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে। সঙ্ঘাতকে উসকে দিতে চায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের কথায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তারা বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠে দাঁড়াতে দিতে চায় না। এ কারণে মাঠে নামলেই রুখে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিবের উল্লিখিত কথায় প্রতীয়মান হয়, আক্রান্ত হলে তারাও ছাড় দেবেন না। কেননা কারা ‘শুরুতে’ সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে- কথা দ্বারা সেটাই বোঝায়। এমন পরিস্থিতিতে শনিবারই সঙ্ঘাত বেধে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সমাবেশের নামে ‘চর দখলে’ মেতে উঠেছে দেশের বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল। এটা অস্বস্তিকর ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধাচরণ।

তিনি আরও বলেন, রাজপথ দখল বা প্রতিপক্ষের রাজনীতি প্রতিহতের ঘোষণা ‘নোংরা খেলা’। এতে করে সত্যিকারের সহিংসতার পথ সৃষ্টি হবে। আগামী নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হবে। ভোট নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। রাজপথ দখল না করে রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ মানুষের মন জয় করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একইদিন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিত্যাগ করা উচিত বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের জন্য পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।

এ ধরনের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনার জন্ম হয়, যা নাশকতার দিকে বাঁক (টার্ন) নিতে পারে। তিনি বলেন, দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উচিত হবে নির্বাচনের আগে সংযত আচরণ করা। যদি তারা সংযত না হয় তবে আগামী নির্বাচন আরও সমস্যা, সংকটাপন্ন ও সঙ্ঘাতময় হয়ে উঠবে। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পরিবেশ সৃষ্টি হোক।

এদিকে শনিবারের এই সমাবেশ ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্টরা সরকারি এবং বিরোধী উভয় জোটকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বিএনপির প্রথমে সমাবেশ ছিল আজ বৃহস্পতিবার। কিন্তু তারা এটি টেনে নিয়েছে শনিবার।

ওইদিন আগে থেকেই মহানগর নাট্যমঞ্চে আওয়ামী লীগের কর্মী সভা ছিল। একইদিন বিএনপি ওই কর্মসূচি না দিলেও পারত। অপরদিকে আওয়ামী লীগের শনিবার পূর্বঘোষিত কর্মী সভা ছিল। তারা ড. কামাল হোসেনসহ বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশের পাল্টা হিসেবে কর্মী সভাকে সমাবেশে পরিণত করেছে। এ কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

যদিও এ ব্যাপারে বিএনপির তরফে বলা হচ্ছে, পুলিশের পরামর্শেই তারা সমাবেশ বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে শনিবার ডেকেছেন। বুধবার মির্জা ফখরুল ইসলাম এ ব্যাপারে বলেন, বিএনপি প্রথম বৃহস্পতিবারই সমাবেশ করতে চেয়েছিল।

বন্ধের দিনে সমাবেশ হলে সুবিধা হয়- এ কথা বলে সমাবেশের দিন পরিবর্তনের জন্য বলেছিল পুলিশ। সে কারণে তা শনিবার নেয়া হয়েছে। এখন পুলিশ বলছে, ওইদিন আরেকটি কর্মসূচি আছে। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, ওই প্রোগ্রামের সঙ্গে আমাদের জনসভার কী সম্পর্ক? কোথায় কোথায় বিরোধ, বুঝতে পারছি না।’ এ সময় আরও বলেন, শনিবার আওয়ামী লীগের একটি ‘মতবিনিময় সভা’ আছে।

সেটি হবে মহানগর নাট্যমঞ্চে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সেটি অনেক দূর। এখানে বিরোধের কী আছে? তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি জনসভাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা উসকানিমূলক কথা বলছেন।

আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেবে না। পাল্টা কর্মসূচি দেয় তারা, যারা ভয় পায়। আমরা ভয় পাই না।

অক্টোবরজুড়েই উত্তপ্ত মাঠ : এদিকে কেবল শনিবারের সমাবেশ ঘিরেই নয়, গোটা অক্টোবরজুড়েই রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে অক্টোবরজুড়ে মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৪ দল।

পরবর্তীকালে জেলায় জেলায় সমাবেশ করবে ক্ষমতাসীন এই জোট। এছাড়া ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে। অপরদিকে ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়, সম্ভাব্য নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন সামনে রেখে মাঠে নামবে বিএনপি ও তাদের জোট।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট যৌথভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পাঁচ দফা দাবি ও নির্বাচন-পরবর্তী ৯ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। বিএনপি পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার দেয়া কর্মসূচিতেও সম্পৃক্ত থাকবে বলে জানা গেছে। মাঠে এভাবে উভয়পক্ষ সক্রিয় থাকলেও সেটা বাড়তি উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। আর প্রতিহত করতে গেলে সঙ্ঘাত বেধে যেতে পারে।

এমন পরিস্থিতি সার্বিকভাবে দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনীতি সঙ্ঘাতপূর্ণ হলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে অর্থনীতিতে নেতিবাচক দিক ছিল বিনিয়োগের অভাব।

এর অন্যতম কারণ হল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি ধারণা ছিল হঠাৎ করে রাজনীতিতে অস্থিরতা শুরু হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অস্থিরতার পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। কোনো পক্ষই ছাড় দিতে চাচ্ছে না।

এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। এতে কর্মসংস্থান ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আরও বলেন, অস্থিরতার বছরে আরেকটি আশঙ্কা হল দেশ থেকে টাকা পাচার। এটি বন্ধ করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দু’পক্ষই অনড় অবস্থানে থাকলে পরিস্থিতি খারাপের দিক যাবে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে অর্থনীতিতে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।

কারণ উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করবেন পরিস্থিতি কোনো দিকে যায়, তা বিবেচনার জন্য। পাশাপাশি পণ্য বাজারজাতকরণে পরিবহন সমস্যাসহ আরও অনেকগুলো সমস্যা দেখা দেবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইবে না। অন্যদিকে ভোক্তাদের দিক থেকেও সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে চাহিদা কমে যাবে। রাজনৈতিক সংকটের বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে বিষয়টি অনুধাবন করে দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version