এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী) সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা বাতিল করে বৃহস্পতিবার পরিপত্র জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরিপত্র জারির পর বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) জানিয়েছে, ৪০তম বিসিএসে কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।

এদিকে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বুধবার রাত থেকে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধার পরিবার’ নামে দুটি সংগঠন। ছয় দফা দাবিতে শনিবার বিকালে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড’।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (আগের প্রথম শ্রেণী) এবং দশম থেকে ১৩তম গ্রেডের (আগের দ্বিতীয় শ্রেণী) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হল। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে কোটা ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল থাকবে। শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর বুধবারই নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। পরদিনই পরিপত্র জারি হল। এর মাধ্যমে ৪৬ বছর ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে যে কোটা ব্যবস্থা ছিল তা বাতিল হয়ে গেল। সরকারি চাকরিতে নিয়োগে এতদিন ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। পরিপত্রে বলা হয়, ‘সরকার সকল সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন কর্পোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ জারি করা কোটা পদ্ধতি সংশোধন করল।’ তবে কমিটির একটি সুপারিশ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে পর্যালোচনা করে যদি কোনো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা অপরিহার্য হয়, তাহলে সরকার সেই ব্যবস্থা নিতে পারবে- এ বিষয়ে পরিপত্রে কিছু বলা হয়নি।

পরিপত্র জারির পরই ৪০তম বিসিএসের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নয়, মেধায় নিয়োগ হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। বৃহস্পতিবার পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক যুগান্তরকে বলেন, আমরা ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিলাম, কোটা বিষয়ে সরকারের সর্বশেষ গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডার নিয়োগ হবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে এই বিসিএসে কোটা নয়, মেধা থেকে নিয়োগ হবে। এছাড়া কয়েকটি নন-ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোটার সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিলাম। সেই নিয়োগগুলোতেও সরকারের সর্বশেষ কোটার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। তবে যেসব নিয়োগ আগের, যেমন ৩৯তম বিশেষ বিসিএসে ক্যাডার নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের কোটানীতি ব্যবহার করা হবে।

কোটার পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে কয়েক মাস আগে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি প্ল্যাটফর্ম- ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এরপর কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেয় সরকার। ওই কমিটি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা সম্পূর্ণ তুলে দেয়ার সুপারিশ করে, যা বুধবার মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়।

কোটা বাতিলের পরিপত্র জারির প্রতিক্রিয়ায় আংশিক স্বাগত জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, কোটা পদ্ধতির সংস্কার চেয়েছি, বাতিল নয়। সব চাকরিতে সংস্কার চেয়েছিলাম শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে নয়। এছাড়া ‘কোটা বহাল চাইলে আন্দোলন করতে হবে’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে তারা মর্মাহত বলেও জানান নুরুল হক নুরু।

কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ইঙ্গিত দেন, কোটার পক্ষে জোরালো আন্দোলন হলে নতুন সিদ্ধান্ত আসতেও পারে। এরপর রাতেই মন্ত্রিসভার ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধার পরিবার’ নামে দুটি সংগঠন রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের অবস্থানের কারণে বৃহস্পতিবার শাহবাগে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ছয় দফা দাবিতে শনিবার বিকালে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড’। তাদের দাবিগুলো হল- কোটা পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন বাতিল, বিসিএসসহ সব চাকরির পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি থেকে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাস্তবায়ন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, স্বাধীনতাবিরোধীদের বংশধরদেরও সরকারি চাকরি থেকে বহিষ্কার, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিচার, ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনে হামলাকারীদের শাস্তি।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পাশাপাশি বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীও তাদের কোটা সংরক্ষণের দাবি তুলেছে। আদিবাসী সাধারণ ছাত্র কোটা সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নিপুণ ত্রিপুরা বলেন, ‘আদিবাসীরা যেহেতু তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, সেক্ষেত্রে এটা (কোটা) আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সরকার বলেছে, তারা বৈষম্য কমানোর জন্য কোটা তুলে দিয়েছে। কিন্তু আদতে এতে বৈষম্য বেড়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।’

ওদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া কি আগে তা দেখা যাক। তারপর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা যা করেছেন, তা অন্য কেউ করেননি। কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। ন্যায় ও বাস্তবসম্মত দাবি হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই তা দেখবেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিল হলেও রাজাকারদের সন্তানদের চাকরি দেয়া হবে না। বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে যমুনা টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো কোটা চালু হয়। বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হয় অগ্রাধিকার কোটায়। বাকি ৪৪ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধা কোটায়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতেও আছে বিভিন্ন ধরনের কোটা। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে কোটা আগের মতোই থাকবে। বিদ্যমান কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জোরালো আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলন চলাকালে দুই দফায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের মারধর করে। তাদের সেই আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ এপ্রিল সংসদে বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। পরবর্তীকালে সংসদে তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখতে হাইকোর্টের রায় আছে।

এরপর শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নামেন। ২ জুলাই সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি পর্যালোচনা, সংস্কার বা বাতিলের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের সচিবদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সরকার। ১৭ সেপ্টেম্বর কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেয়। সরকারের এই কমিটি তাদের প্রতিবেদনে কোটা বাতিলের বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরে। এই কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার শাহবাগ থানায় চারটি ও রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান এজাহারভুক্ত আসামি। বাকি চার মামলার কয়েকশ’ আসামির সবাই অজ্ঞাতনামা। মামলাগুলোর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় দুটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখতারুজ্জামানের বাসভবনে ভাংচুর, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের গাড়ি ভাংচুর ও পুলিশের বিশেষ শাখার এক সদস্যের মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের চারটি ঘটনা রয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version