এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে অন্য ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আছেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন।
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে এ মামলার বিচারকাজ চলে। ২০০৪ সালে সংগঠিত ঘটনার ১৪ বছর পর রায় হওয়ায় খুশি আহত ও নিহত নেতাকর্মীদের স্বজনরা। তবে তারা অন্য আসামিদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, রায়ে তারা অখুশিও নন আবার পুরোপুরি খুশিও নন।
ঘোষিত রায়কে ফরমায়েশি উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।
দলটির পক্ষ থেকে সাত দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রায়ে ন্যায়বিচার পাননি উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে আপিল করার কথা জানিয়েছেন। রায় ঘিরে সারা দেশে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। নিরাপত্তার মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ আনন্দ মিছিল করে। তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ করে বিএনপি। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যাবজ্জীবন শাস্তি পাওয়া আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করার কথা জানিয়েছেন।
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর মামলার সবশেষ ধাপ যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে ১০ই অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২২৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। গত বছরের ৩০শে মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দকে জেরা শেষের মধ্য দিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলায় মোট ৫২ আসামির নাম থাকলেও অন্য মামলায় জামায়াতের সাবেক নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় মামলার আসামি সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন কয়েক শ’ নেতাকর্মী। ঘটনার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে, তাঁর শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনার ১৪ বছরের বেশি সময় পর বিচার শেষে এ রায় এলো।
গতকাল রায়ের আগে বিশেষ আদালতের ওই এজলাসে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের একজন করে প্রতিনিধিকে আদালতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা। পুলিশের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের বাকবিতণ্ডা হয়। এ ধরনের সিদ্ধান্তে অনেকেই আদালতের ভিতরে প্রবেশ করতে না পেরে আদালত ভবনের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আদালতে প্রবেশের প্রথম ফটকের সামনেও কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। যেসব গণমাধ্যমকর্মী আদালতের ভেতরে প্রবেশ করেছেন তাদের মোবাইল ফোন জমা দিয়ে আদালতের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে। সোয়া ১১টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীরা আদালতের এজলাসের সামনে গেলেও প্রথমে তাদের আদালতের এজলাসে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। পরে উপস্থিত সিনিয়র সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ জানালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অুনরোধে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের প্রবেশে অনুমতি দেন।
সকাল ১১টা ৩৭ মিনিটে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এজলাসে তার আসনে বসেন। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়ার সময় ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। একই সঙ্গে আদালতে থাকা মাইকও বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থাতেই রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। দুপুর ১২টার দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ আবারো শুরু হয়। কিন্তু ১২টা ৮ মিনিটে আবারো বিদ্যুৎ চলে যায়। বিচারক রায় পড়ে শেষ করার কিছুক্ষণ আগে বিদ্যুৎ সরবারহ শুরু হয়।
রায়ে ১৪টি বিবেচ্য বিষয় উল্লেখ করে আদালত বলেন, সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল ঘটনার পূর্বে বিভিন্ন ঘটনাস্থলে অত্র মোকদ্দমার আসামিগণ অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সভা করে পরিকল্পিতভাবে ঘটনাস্থল ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এর সামনে ঘটনার তারিখ ও সময়ে মারাত্মক সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ২৪ জনকে হত্যা করে ও শতাধিক নেতাকর্মীকে মারাত্মকভাবে জখম করে মর্মে আসামিগণের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসিকিউশন পক্ষ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে আসামিগণকে শাস্তি প্রদান করা যুক্তিসঙ্গত বলে অত্র আদালত মনে করে।
হত্যা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- লুৎফুজ্জামান বাবর, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম, মো. আব্দুস সালাম পিন্টু ও হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, শেখ আব্দুস সালাম, মো. আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মাসুম বিল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে খালিদ সাইুফুল্লাহ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আসামিদের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়েছে হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। একই সঙ্গে আসামিরা চাইলে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন। এই ১৯ জনকে বিস্ফোরক আইনের মামলাতেও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি এই ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিন্ন অভিপ্রায়ে পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখমের অভিযোগে এই আসামিদের ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে এই আসামিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের সাজাই কার্যকর হবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই ও জঙ্গিনেতা তাজউদ্দীন এবং হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ এখনো পলাতক।
হত্যা, বিস্ফোরক ও গুরুতর জখম করার অভিযোগের পৃথক ধারায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন- তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), শাহাদাত উল্লাহ ওরফে জুয়েল, আব্দুর রউফ, ওরফে আবু ওমর হোমাইরা, সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম আরিফ, মহিবুল মুত্তাকিন (পলাতক), আনিছুল মুরসালিন (পলাতক) মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আব্দুল হাই (পলাতক), রাতুল আহমেদ বাবু (পলাতক)। পাশাপাশি বিস্ফোরক আইনের অন্য ধারায় আসামিদের ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে আদালতের রায়ে। তবে, সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে এই আসামিদের ক্ষেত্রে শুধু যাবজ্জীবন সাজা খাটতে হবে।
রায়ে এই মামলার আসামি আট পুলিশ ও তিন সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন বিচারক। তাঁদের মধ্যে খালেদা জিয়ার ভাগনে ও নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ডিউক, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান (পলাতক), সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন (তদন্ত কর্মকর্তা) ও সাবেক পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান খানকে (পলাতক) দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের আরেকটি আদেশে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও সাবেক এএসপি আবদুর রশীদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুই মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ৩১ আসামিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তায় ঢাকার ওই আদালতে নিয়ে আসা হয়। কাটগড়ায় তাদের উপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করেন আদালত। আর তারেক রহমানসহ বাকি ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচারকাজ চলে।
বিরোধী দলের প্রতি উদারনীতি প্রয়োগ করতে হবে: আদালত
গতকাল ২১শে আগস্ট মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্য দিবালোকে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস স্পেশালাইজড মারণাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণের মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটানো হয়। প্রশ্ন উঠে, কেন এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার? রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? শুধু আক্রমণই নয় দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। আদালত বলেন, রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে কি বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। সাধারণ জনগণ এ রাজনীতি চায় না। সাধারণ জনগণ চায় যেকোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে সেই দলের নীতি, আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ধারণ করা। আর সেই সমাবেশে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে পরবর্তীতে দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে। আদালত বলেন, সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ:) এর দরগা শরীফের ঘটনা, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ওপর হামলা বা রমনা বটমূলে হামলার মতো ঘটনা এবং এই মামলার ঘটনায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নৃশংস বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার পুনরাবৃত্তি আদালত চায়না। আদালত আরো বলেন, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে উল্লিখিত নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলে আদালত মনে করে।
আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া: এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মানবজমিনকে বলেন, ‘আমরা যুক্তিতর্কের শুনানিতে আসামিদের বিরুদ্ধে আইনের বিধান মোতাবেক দৃষ্টান্তমূলক ও সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছিলাম। আদালত রায় দিয়েছেন। এখন আমরা এই রায় পর্যালোচনা করে দেখবো। যদি দেখা যায় যে কারো সাজা কম হয়েছে তাহলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, ওই ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও আহতদের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে।’ আর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের অন্য আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল জানান, তারা এ রায় পর্যালোচনা করবেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাহজাহান রায়ের প্রতিক্রিয়া মানবজমিনকে বলেন, ‘রায়ে সন্তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্ট হওয়ার বিষয় নয়। আমরা এই রায়ে হতাশ। আর হতাশ এ কারণে যে আমরা আশানুরূপ রায় পাইনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করবো।’ এ মামলায় বিএনপি নেতা তারেক রহমানের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী একেএম আখতার হোসেন। গতকাল রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘আদালত তাঁর নিজস্ব বিবেচনায় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু তিনি (তারেক রহমান) যেহেতু দেশে নেই তাই এই রায়ের প্রেক্ষিতে এখন কিছুই বলতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘যদি দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কেউ আপিল করতে চান তাহলে তাকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাই তারেক রহমানও যদি উচ্চ আদালতে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে চান তাহলে তাকে আগে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।’ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক মামলার রায়। আমাদের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত রায়। যে অভিযোগ দেখিয়ে তাকে (লুৎফুজ্জামান বাবর) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তাতে এই সাজা পাওয়ার মতো অপরাধ তিনি করেন নি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো এবং আশা করি ন্যায়বিচার পাবো।’
ফিরে দেখা: ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে নৃশংস ওই গ্রেনেড হামলার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ ওঠে। হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০১২ সালের মার্চে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ গঠন করেন সংশ্লিষ্ট আদালত। এরপর সাড়ে ছয় বছর ধরে বিচারকাজ চলেছে। এই মামলায় প্রথম দফা অভিযোগপত্রে ২২ জন আসামি থাকলেও অধিকতর তদন্তে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করা হয়। ২০১২ সালের ১৮ই মার্চ দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ গঠন করেন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক। এর আগে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ই জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অভিযোগপত্রে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নান (অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর)সহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলার অধিকতর তদন্ত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২রা জুলাই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।
সতর্কাবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: মামলার রায়কে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিপুল র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন ছিল সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ওই এলাকাসহ পুরো ঢাকাজুড়ে ছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সকাল থেকেই নাজিম উদ্দিন রোড এলাকার প্রবেশপথগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। চাঁনখারপুল থেকে শুরু করে আশপাশের সড়কগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় জনসাধারণের চলাচলে ছিল কড়াকড়ি। প্রতিটি মোড়েই পথচারীদের তল্লাশি করতে দেখা গেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন বাড়ি-মার্কেটের ছাদে অবস্থান নেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আদালত ভবনের চারপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। এ এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। সকাল থেকে রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট, মগবাজার, বকশিবাজার, বংশাল, রায়শা বাজার মোড়, জজকোর্ট এলাকায় ছিল বাড়তি পুলিশ মোতায়েন। জজ কোর্ট এলাকায় যাতায়াতকারী প্রায় সবাইকেই তল্লাশি করেছে পুলিশ।
গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিদের কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে আসা-যাওয়ার পথে ছিল পুলিশ ও র্যাব। প্রিজনভ্যানের আগেপিছে ছিল পুলিশ ও র্যাবের কয়েকটি গাড়ি, পিকআপ। সেইসঙ্গে র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স ছিল মোটরসাইকেলে। দুপুর ১টায় আসামিদের যখন আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তখনই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় তাদের যাওয়ার পথ। এ সময় রাস্তায় পথচারীদের সরিয়ে দেয়া হয়। ডিএমপি’র উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় এজন্য পুলিশ সতর্কাবস্থায় ছিল। পুরো রাজধানী জুড়েই পুলিশ বিশেষভাবে তৎপর ছিল বলে জানান তিনি।