এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের বিভিন্ন শহর, উপ-শহর ও গ্রমীণ সড়ক উন্নয়ন ব্যয়ে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতি কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে একেক সংস্থা একেক রকম ব্যয় করছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যয়-ব্যবধান দ্বিগুণ, তিনগুণ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি।

উন্নয়ন ব্যয়ে কেন এ তারতম্য, সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে জনগণকে অবহিতও করা হচ্ছে না। এ কারণে প্রকৌশলীদের প্রতি মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাস ক্রমেই বাড়ছে।

সম্প্রতি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (জিসিসি) থেকে তিনটি প্রকল্প অনুমোদন করতে একনেকে পাঠানো হয়েছে। এসব প্রকল্পের আওতায় শহরের ড্রেন ও সড়ক উন্নয়ন করা হবে। ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজালে (ডিপিপি) প্রতি কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আর ড্রেনেজ উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে পাঠানো সড়ক উন্নয়ন এক প্রকল্পের উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। একই সময়ে একেনেক এ দুটি প্রকল্প আসায় ওই বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যয়ের বিস্তর ফারাক দেখে রীতিমতো হতবাক। তারা বলছেন, একই আকৃতির সড়ক অথচ ব্যয়ের ব্যবধান এত হবে কেন? দুই সিটি কর্পোরেশনের এ চারটি প্রকল্প শিগগিরই একনেক সভায় উত্থাপন হবে বলে জানা গেছে।

একনেকে অনুমোদিত বিভিন্ন প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উপজেলা পর্যায়ের প্রতি কিলোমিটার পাকা সড়ক উন্নয়নে ৮০-৮৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আর গ্রামীণ জনপদের প্রতি কিলোমিটার পাকা সড়ক উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে ৬০-৫০ লাখ টাকা।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নবগঠিত মাতুয়াইল এলাকার প্রতি কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে এ সংস্থার সড়ক উন্নয়ন ব্যয়ের বিপরীত চিত্রও রয়েছে। যাত্রাবাড়ী এলাকার তিন কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে এ সংস্থা ব্যয় করেছে ১১৬ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে প্রকৌশল বিশেষ ম. ইনামুল হক বলেন, ‘দেশে সড়ক, ড্রেন, ফুটপাত উন্নয়নে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। এসব সংস্থার সড়কের কিলোমিটার প্রতি উন্নয়ন ব্যয়ের বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংস্থা বা সড়ক ভেদে ব্যয়ের উচ্চ মাত্রার পার্থক্য দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা এসব প্রকল্পের অর্থ লুটপাট করে খাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক উন্নয়নে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এ ব্যয় নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে সন্দেহ ও সংশয় থাকলেও সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয় না। সরকারের উচিত প্রতি বছর সংবাদ সম্মেলন করে সড়কের ব্যয় বিস্তর ফারাকের কারণ জনগণকে অবহিত করা।’

ডিপিপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এ প্রকল্পের আওতায় ২৩৮ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হবে। আর এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর গাজীপুর সিটির ৪৪ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা করা হবে। যার ব্যয় ২৩২ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ৫ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আর বিটুমিনের রাস্তা করতে গাজীপুর সিটিতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সিসি রাস্তা করতেও ব্যয় ধরা হয়েছে কিলোমিটারে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা।

এ প্রকল্পে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১ ও ৫ নম্বর জোনের রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর ২, ৪ ও ৩ নম্বর জোনের জন্য নেয়া প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮৬০ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া রাস্তা উন্নয়নের জন্য একটি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট করা হবে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে। এ তিন প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয় ৫ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তিন প্রকল্পের অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা কমিশনেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পে প্রায় ৫০ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ড্রেন-ফুটপাত নির্মাণেও কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। শুধু জলাবদ্ধতাপ্রবণ রাস্তাগুলো আরসিসি করার সংস্থান রেখে বাকি রাস্তাগুলো বিটুমিন দিয়ে করার কথা বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণের ৬২ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে ফুটপাত উন্নয়নে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। গাজীপুর সিটিতে ১২৫ দশমিক ৮৪৯ কিলোমিটার ফুটপাত-ড্রেন নির্মাণ করা হবে- যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৫ কোটি ৩০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এতেও প্রতি কিলোমিটারে গড় ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ বলেন, ‘সড়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের সঠিক কোনো হিসাব দেয়া যায় না। কেন না, সড়কের প্রশস্ততা, উঁচু-নিচু এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদসহ নানাবিধ বিষয় বিবেচনা করে সড়ক উন্নয়ন ব্যয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ কারণেই ব্যয়ে তারতম্য হয়।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সড়ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয়ের সঠিক হিসাব দেয়া সম্ভব নয়। কেন না, একেক সড়কে একেক ধরনের ব্যয় হয়ে থাকে। সড়কের অবস্থান বিবেচনায় ব্যয়ে তারতম্য হয়। এর আগে যাত্রাবাড়ীতে আমাদের তিন কিলোমিটার সড়ক করতেই খরচ হয়েছে ১১৬ কোটি টাকা। প্রশস্ততা ও অবৈধ দখলদার হটানোসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের কারণে ওই পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে। এ জন্য স্বতন্ত্র দুটি সড়ক বিশ্লেষণ করে কম-বেশি বলা সমুচীন হবে না।’

জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরের সড়ক উন্নয়নের ব্যয়ের সঙ্গে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সড়ক উন্নয়ন ব্যয়ের মিল থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কেন না, গাজীপুরের সড়কগুলো নতুন করে করা হচ্ছে। আর ঢাকায় সাধারণ সড়ক সংস্কার করা হয়। তাছাড়া, সড়ক উন্নয়ন ব্যয় কম-বেশি হয়ে থাকে সড়কের প্রশস্ততাসহ সড়ক বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসহ নানাবিধ কারণে। সড়কের অবস্থান অনুযায়ী সড়ক উন্নয়নে ব্যয় কম-বেশি হয়ে থাকে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version