এ কে এম শাহনাওয়াজ : কয়েকদিন আগে রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক-সহকর্মীর সঙ্গে একটি সস্তা রসিকতা করে ফেললাম। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ঘোরতর রাজনৈতিক নেতা নন, তবে নিজ দলের প্রতি আবেগ রয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের অনুসারী, তাই অখুশি।
চা পানের টেবিলে তাকে ক্ষেপিয়ে দিতে চাইলাম। বললাম দেখুন এখন মনে হয় রাজনীতি বিজ্ঞান টাইপের বিভাগগুলো তুলে দিয়ে শান্তি ও সংঘর্ষ ধরনের বিভাগ বেশি করে চালু করা প্রয়োজন। কারণ কারিকুলামের ভেতরে না ঢুকে নাম দিয়ে যদি সাধারণ মানুষ বিচার করে তাহলে ‘রাজনীতি’ শব্দটি তাদের প্রথমেই বিতৃষ্ণা জন্মাতে পারে। আমাদের ক্ষমতাবিলাসী (‘লোভী’ শব্দটি ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম) দলগুলো ক্ষমতা পাওয়া বা আঁকড়ে রাখার জন্য এমন কোনো কর্ম নেই যে করতে পারে না। অবশ্য একে কর্ম না বলে কুকর্ম বলাই শ্রেয়।
রাজনীতি নানারূপে ছিল মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই। সে কারণে মানুষ রাজনীতিবিচ্ছিন্ন নয়। সাধারণ বিচারে রাজনীতি একটি ইতিবাচক শব্দ। কিন্তু আমাদের মতো দেশে ক্ষমতাপ্রিয় রাজনীতিকরা রাজনীতিকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এমনভাবে নামিয়ে এনেছেন, এখন শব্দটিই দূষিত হয়ে গেছে। রাজনীতি একটি ষণ্ডামার্কা গালিতে পরিণত হয়ে গেছে যেন। এখন নানা ঘরানার রাজনীতিকের বিকাশ হয়েছে। কেউ জাত রাজনীতিবিদ, কেউ ভুঁইফোড় রাজনীতিক, কেউ বণিক-রাজনীতিক, কেউ আইনজীবী-রাজনীতিক, কেউ সাংবাদিক রাজনীতিক আবার কেউ শিক্ষক রাজনীতিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর কোনো পক্ষেরই আর ব্যক্তিগত সত্তা বা ব্যক্তিত্ব থাকে না। শুধু দলীয় নেতাদের নির্দেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বচনে চলনে কখনও এদের নির্লজ্জ, অমানবিক ও বিবেকবর্জিত বলে মনে হয়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ের পর বেশ কয়েকটি দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাজনীতিকদের নানা নাটক ও বচন দেখতে হল- শুনতেও হল। একটি বিষয়ে এখনও আমার গোলকধাঁধা কাটেনি। আমি অনেক লেখায় আইন-আদালতের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলাম, যদি জানতে পেতাম কী কী আচরণ বা বক্তব্যে আদালত অবমাননা হয় তাহলে বড় উপকার হতো। কিন্তু অভাজনের আর্তি কেউ শোনেননি। আগে শুনতাম ‘হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না’। এখন দেখতে পাই ক্ষমতার নির্দেশে সবই নড়ে। আগে জানতাম আদালতের রায় সবার মান্য করতে হয়। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাটাও অপরাধ। সেটিও আদালত অবমাননা। নিম্ন আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে, অতঃপর আপিল আদালতে যাওয়া যেতে পারে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, কোনো রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা এবং স্লোগান তোলার মতো অমার্জিত কাজ করা হলেও আজকাল আদালত অবমাননা হয় না।
আদালতের মান-অপমান না হয় ছেড়ে দিলাম। রাজনীতি যেভাবে আমাদের অমানুষ করে দিচ্ছে তা দেখে খুব হতাশ হতে হচ্ছে। আদালতে কোনো চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণার পর দণ্ডিত পক্ষ যেভাবে রায় বর্জন করে স্লোগান তুলেন তা আমাদের বিস্মিত করছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ১৪ বছর ধরে গ্রেনেড হামলা মামলা চলেছে আদালতে। অভিযুক্ত পক্ষ নিয়মমাফিক শুনানি করেছেন অর্থাৎ আদালতে লড়ে যাচ্ছেন। তড়িঘড়ি কোনো রায় হয়নি এ মামলায়। স্বাভাবিক নিয়মেই রায় হয়েছে। এরপর যখন বিএনপি নেতৃত্ব, বিএনপিপন্থী আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ দলীয় মদে মত্ত সবাই এ রায়কে প্রত্যাখ্যান করছেন, আরোপিত রায় বলছেন, তখন মনে হচ্ছে বিচারকের আর বিচারের প্রয়োজন নেই। অন্যায় শত হলেও অভিযুক্তদের মুক্তির রায় দিতে হবে। রাজনীতিতে এখন সম্ভবত যুক্তি, আইন ও বিবেকের কোনো স্থান নেই। রাজনীতিকরাই ঠিক করে দেন কোনটি রাজনৈতিক মামলা- কোনটি মিথ্যা মামলা।
আরেকটি বিস্ময় হচ্ছে, রায়-উত্তর বিএনপির বিশেষ প্রতিক্রিয়া। দলভুক্ত বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা একমাত্র তারেক রহমানের দণ্ডের বিরুদ্ধে নিজেদের কণ্ঠ উচ্চকিত করছেন, অর্থাৎ বলা যায় সে সময়ের নিজেদের সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও দলীয় সহযোগীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বিএনপি নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। হারিছ চৌধুরীর মতো বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের দণ্ডাদেশ নিয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অর্থাৎ জঘন্য অপরাধে নিজেদের ভূমিকা কবুল করেছেন। এ কারণেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে রক্ষা করার এ প্রতিবাদী আওয়াজ যে বুমেরাং হচ্ছে তা কি বিএনপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন?
নৃশংস গ্রেনেড হামলার পর নানা প্রাসঙ্গিকতার কারণে অনেক প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল। আর এর যোগফলে এ হামলার দায় বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধেই আরোপিত হয়। সেসময় উত্থাপিত কতগুলো প্রশ্ন ছিল খুবই যৌক্তিক। যেমন- ১. সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এ জনসভা মুক্তাঙ্গনে অনুষ্ঠানের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। হামলার পরিকল্পকদের কাছে হামলার জন্য মুক্তাঙ্গন সুবিধাজনক হবে না বলেই হয়তো অনুমতি দেয়া হয়নি। তাই ট্রাকের ওপর একটি অস্থায়ী মঞ্চে বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়, ২. প্রথা অনুযায়ী এবং নিরাপত্তার জন্য সাধারণত এ ধরনের সমাবেশস্থলে গোয়েন্দারা চলে আসেন, প্রয়োজনীয় তল্লাশি করেন। সাদা পোশাকে তাদের অবস্থান থাকে। কিন্তু সেদিন কাউকে পাওয়া যায়নি। কোনো তৎপরতাও ছিল না, ৩. আওয়ামী লীগ নেত্রী ভাষণ দেয়ার আগে চারপাশে দলীয় নেতাকর্মীরা সাধারণত নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেন। কিন্তু সেদিন পুলিশ এ বেষ্টনী তৈরির অনুমতি দেয়নি, ৪. সেদিনই প্রথম মঞ্চের আশপাশে পোশাকধারী বা সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি, ৫. সবসময়ই এ ধরনের কর্মসূচির সবকিছু গোয়েন্দারা ভিডিওতে ধারণ করে। কিন্তু সেদিন এ তৎপরতা চোখে পড়েনি, ৬. অমন একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পর পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে এসে দ্রুত আলামত রক্ষার ব্যবস্থা করে। অথচ সেদিন পানি দিয়ে ধুয়েমুছে আলামত নষ্ট করা হয়, ৭. এতবড় একটি ঘটনার পরও তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ জিডি গ্রহণ করেনি, ৮. অনেক হাসপাতালই অজ্ঞাত নির্দেশে আহতদের ভর্তি করা হয়নি, ৯. সংসদে এ বিষয় উত্থাপিত হলে স্পিকার আলোচনা বন্ধ করে দেন, ১০. শোকে মুহ্যমান না হয়ে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মহান সংসদে দাঁড়িয়ে মর্মান্তিক রসিকতা করে বলেন শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন, ১১. ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি সরকার এমন জঘন্য ঘটনার কোনো তদন্ত করেনি। উপরন্তু হামলাকারী হিসেবে সন্দেহভাজন অনেককে দেশ ত্যাগে সাহায্য করেছিল। আর জজ মিয়া নাটকের কথা তো দেশবাসী জানেই।
এসব অকাট্য বাস্তবতা প্রকাশ্য থাকার পরও শুধু রাজনীতির কারণে আজ যখন বিএনপির সর্বস্তরের দলীয় নেতারা কোনো রকম লজ্জা, মানবিকতা ও বিবেকের ধার না ধেরে একজনকে রক্ষার জন্য অপযুক্তি আওড়াচ্ছেন, তখন জাতি হিসেবে আমরা লজ্জায় অধোবদন হচ্ছি। যখন সাংবাদিকদের সামনে এসব নেতা সাজানো কথা বলেন তখন বিস্ময়ের সঙ্গে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নজরুল ইসলাম খান, মওদুদ আহমদের মতো সিনিয়র নেতাদের দিকে তাকাই। বলাবাহুল্য, তারা সবটাই জানেন। এতবড় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবিকতার জায়গা থেকে তাদের মন কি একটু কাঁদেনি? বিবেক কি বিদ্রোহ করেনি? সত্যের কাছে ফিরে এসে নতুনভাবে রাজনীতির হাল ধরতে কি ইচ্ছে করে না? আমি তাকাই টকশোতে বিএনপিপন্থী সাংবাদিক নেতা বা আইজীবীদের দিকে। তারাও কেমন অমানবিক ও বিবেকহীন হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা যখন শেখানো বুলিতে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির গুণবর্ণনা করেন আর অমন নৃশংস ঘটনার বিচার না করার জন্য সে সময়ের নিজ দলের সমালোচনা থেকে বিরত থাকেন, তখন শিক্ষক হিসেবে নিজেই লজ্জিত হই। শুনেছি এক সময় নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বলা হতো জাতির বিবেক!
আসলে নষ্ট রাজনীতি আমাদের সব দিক থেকেই ভেঙে ফেলেছে। ষাটের দশকে, এমনকি সত্তরের দশকেও দলীয় সমর্থক শিক্ষক ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা তাদের নিজেদের গাইড ও ফিলোসফার মনে করতেন। পরামর্শ নিতে ছুটে যেতেন তাদের কাছে। আর এখন তথাকথিত গাইড-ফিলোসফাররা শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অমার্জিত নেতানেত্রীর আদেশ পালন করার জন্য প্রতিদিন ঘর্মাক্ত হন। কী যে তাদের চাওয়া-পাওয়া তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন!
২১ আগস্টের মামলার এ রায় বিচারিক আদালতের রায়। উচ্চ আদালত ও আপিল আদালতের দরজা তো এখনও খোলা আছে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করাই তো শ্রেয় ছিল বিএনপি নেতাদের। কার্যকারণ সূত্রে এ সত্য মানতেই হবে ২১ আগস্টের নৃশংস সন্ত্রাসী ঘটনা আর ২০১৩-১৪-এর আগুন সন্ত্রাস বিএনপির কপালে সন্ত্রাসীর তকমা শক্তভাবেই এঁটে দিয়েছে। বেগম জিয়া কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রবাসী ও ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার পথে থাকা তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করাটা বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে তখনই অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। এখন এ রায়ের পর তার দলীয় নেতৃত্বের পদ মুলতবি রাখলে তা হতো বিএনপির জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আপিল আদালত থেকে খালাস পেলে না হয় পুনরায় দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়া যেত। নির্বাচনের আগে এ সিদ্ধান্তটি জরুরি বলে আমরা মনে করি। বিএনপির চিন্তা-চেতনা এখনও বড় দুর্বোধ্য আমাদের কাছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়ার যদি সাহস থাকে তবে বর্তমান বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুল করবে না।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়