এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : একজন আমেরিকান এবং একজন আরব সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছেন- টমাস ফ্রিডম্যান নিউইয়র্কে এবং জামাল খাশোগি ইস্তান্বুলে। একজন হাসিমুখে লরেন্স অফ অ্যারাবিয়্যার মতো বের হয়ে এসেছেন এবং সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের কাছের রাজকীয় একটি প্রাসাদে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন।

অন্যদিকে আরেকজন হালকা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছেন এবং ব্যাপকভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাকে দ্রুত তার স্রষ্টার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে টুকরো টুকরো করে।

নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যানকে কেন সৌদিরা ভালোবাসে এবং কেন তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের রিয়াদের একটি প্রাসাদে? তার প্রাচ্যবিষয়ক চিন্তা-কল্পনাকে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য?

কিন্তু তুর্কি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বারবার প্রকাশিত রিপোর্টগুলো যদি সত্য হয়, তবে কি সৌদিরা ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগিকে মারপিট, নির্যাতন, হত্যা ও টুকরো টুকরো করার জন্য গুপ্তহত্যাকারী ১৫ জনের একটি টিমকে পাঠিয়েছিল?

না, এটি আমাদের দুটি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ হতে পারে না। চলুন, আপাতগ্রাহ্য আরও কিছু কারণ খুঁজে বের করি।

নিরস ও কেতাদুরস্ত এক কলামিস্ট : ২০১৭ সালের নভেম্বরে শরতের এক স্নিগ্ধ সকালে আমরা নিউইয়র্কবাসী জেগে উঠলাম এবং আমাদের ‘রেকর্ডধারী পত্রিকা’ (নিউইয়র্ক টাইমস যেমনটি নিজের সম্পর্কে বলে থাকে) হাতে নিলাম এবং পড়লাম আমাদের প্রিয় কলামিস্ট টমাস ফ্রিডম্যান আমাদের বলছেন, তিনি সম্প্রতি সৌদি আরব সফর করেছেন এবং সুদর্শন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসেছেন।

এমনকি তিনি আমাদের জন্য ভালো সংবাদ নিয়ে এসেছেন যে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংস্কার প্রক্রিয়া যদি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান থাকে তা হচ্ছে সৌদি আরবে।’ আমরা আনন্দে আত্মহারা হলাম।

নিউইয়র্ক ও অন্যান্য স্থানে তার শ্রোতাদের উদ্দেশে ফ্রিডম্যান গর্বের সঙ্গে বলেছেন কীভাবে তিনি ও সৌদি প্রিন্স উত্তর রিয়াদের আওজায় প্রিন্সের সুশোভিত প্রাসাদে এক রাতে মিলিত হয়েছেন।

এমবিএস ইংরেজিতে কথা বলেছিলেন এবং সেখানে তার ভাই, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি আরবের নতুন রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ ও আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মুখরোচক খাবার খেতে খেতে খোশগল্পে মেতে উঠেছিলেন। সৌদি আরবের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারণার উদ্দেশ্যে এমন অনেক লেখা তিনি লিখেছেন।

একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যা : ২ অক্টোবর বিবাহ বিচ্ছেদের সত্যায়নের কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য জামাল খাশোগি ইস্তান্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে তিনি বের হয়েছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই।

তুরস্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের বিশ্বাস কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই খাশোগিকে মারাত্মকভাবে প্রহার, নির্যাতন ও হত্যা এবং তার শরীর খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলা হয় কনস্যুলেটের ভেতরে, যা ছিল একটি ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’।

ইস্তান্বুলের যেখান থেকে খাশোগি অদৃশ্য হয়েছেন সেখান থেকে পাওয়া সরকারি রিপোর্টগুলো আশাব্যঞ্জক নয়। তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন, খাশোগি যে পত্রিকার কলামিস্ট ছিলেন সেই ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, খাশোগি ছিলেন সৌদি নেতৃত্বের সমালোচক এবং তাকে ১৫ জনের একটি দল হত্যা করেছে, যাদের উড়িয়ে আনা হয়েছিল হামলাটি সংঘটিত করার জন্য।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্য সব মিডিয়া হাউজও একই ধরনের খবরের প্রতিধ্বনি করেছে। বিবিসির মতে, নিখোঁজ সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি ইস্তান্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে নিহত হয়েছেন- এমন প্রমাণ দেখানো অডিও-ভিডিও ‘তুর্কি কর্মকর্তাদের’ কাছে রয়েছে।

অন্যদিকে নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছে, শীর্ষ তুর্কি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক খাশোগিকে ইস্তান্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে রয়াল কোর্টের শীর্ষ পর্যায়ের আদেশে।

ইস্তান্বুলের সৌদি দূতাবাস থেকে খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার পর দ্রুততার সঙ্গে আরেকটি লেখা লিখেছেন টমাস ফ্রিডম্যান, যেখানে তিনি নিজের উদ্ধৃতি দিয়ে সৌদি আরবের প্রোপাগান্ডা ও খোশগল্প প্রকাশ করে আগের বিভিন্ন লেখা সম্পর্কে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং নিজের প্রতি মার্জনা চেয়েছেন।

এ লেখার মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, যেসব সূত্রকে উদ্ধৃত করে সৌদি আরবের পরিবর্তনের গুণগান তিনি গেয়েছেন তার মধ্যে একজন ছিলেন জামাল খাশোগি। ফ্রিডম্যান আমাদের বলেছিলেন, তার প্রিয় প্রিন্স এমবিএস যা কিছু করছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী একজন ব্যক্তিকেও তিনি খুঁজে পাননি।

হায়! জামাল খাশোগি না ফেরার স্থানে চলে গেছেন এবং আমাদের যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই যে তিনি টমাস ফ্রিডম্যানকে কিছু বলেছিলেন কিনা।

তরুণ একজন সাংবাদিক বন্ধু সম্প্রতি পর্যবেক্ষণ করেছেন কীভাবে আমরা ফ্রিডম্যানের সমালোচনা করি (সৌদি আরবের প্রশংসাকারী হিসেবে) এবং তার লেখাও সমানভাবে পড়ি। কেন আমরা তার লেখা পড়ি? আমার কাছে এর উত্তর একেবারে সহজ।

কয়েক বছর আগে যখন আমি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ লিখছিলাম মৃত ফিলিপ রিয়েফের তত্ত্বাবধানে- একদিন আমি তার অফিসের পার্শ্ববর্তী আমার ডেস্কে বসে নিউইয়র্ক টাইমস পড়ছিলাম।

তিনি আমার কাছে এলেন এবং যখন দেখলেন যে আমি পত্রিকাটি পড়ছি, তখন তিনি চুপিসারে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর নিজের অফিস থেকে কাঁচি নিয়ে ফিরে এলেন। তারপর নিজের চটকদার ইংরেজি টোনে আমাকে বললেন, ‘হামিদ কখনও কাঁচি ছাড়া টাইমস পড়তে বসবে না। আমরা সমাজবিজ্ঞানী, আমরা ময়লা সংগ্রহ করি।’ (টমাসের লেখা কেটে ফেলার দিকে ইঙ্গিত করে)।

খাশোগির ভাগ্য সম্পর্কে আরবের নীরবতার রহস্য কী? বিষয়টি ছিল ১৯৭০-এর দশকের শেষের এবং ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকের। তখনও আমরা প্রিন্ট করা পত্রিকা পড়তাম।

বর্তমানে আমি মনে করি না নিউইয়র্ক টাইমস পড়া মানে কাঁচি নিয়ে ময়লা সংগ্রহ করা বা ভবিষ্যৎ উদ্ধৃতির জন্য কাটিং ও পেস্টিং করে রেখে দেয়া। এর জন্য ভিন্ন একটি রূপক আছে আমার।

নিউইয়র্ক টাইমস হচ্ছে আমেরিকান সমাজের সুস্থতা ও অসুস্থতা মাপার যন্ত্র। এ সমাজ কোথায় আছে এবং কোথায় যাচ্ছে তার নির্ভুল পরিমাপ আমাদের দেয় পত্রিকাটি। এটি একইসঙ্গে আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিধ্বনি ও উৎপাদক।

আমরা টমাস ফ্রিডম্যানের মতো শিশুসুলভ লেখকদের লেখা পড়ি। কারণ নিউইয়র্ক টাইমস এমন ধরনের কলামিস্ট রাখে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পাঠকের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে খুশি রাখার জন্য।

এখানে অনেক দূর থেকে নিজের দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিরাপদ হতে পারে এমন যত্নশীল চিন্তক একজন সাংবাদিকের করুণ পরিণতিও কোনো বিষয় নয়।

এই বিশেষ হত্যাকাণ্ডের মতো রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যার ঘটনাও কেবল একটিই নয়। সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের শাসক সমাজও একই ধরনের নৃশংস কাজ বারবার করেছে।

একইভাবে করছে এর নতুন মিত্র ইসরাইলও। বর্তমানে যেভাবে দেখা হচ্ছে একজন ভিন্নমতাবলম্বী হত্যার ঘটনাকে, তার চেয়ে ইয়েমেনে সৌদি আরবের বোমা হামলার আদেশ অনেক বেশি মাত্রায় খারাপ।

ফ্রিডম্যান হয়তো তার অনর্থক কথাগুলো এখনও বলে যাবেন নিয়মিত; অন্যদিকে জামাল খাশোগির বেলায় বিশ্বের ভয়- তিনি হয়তো আর কখনও নিজের দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আশা শেয়ার করতে পারবেন না।
আলজাজিরা থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম। হামিদ দাবাশি : কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান স্টাডিজ অ্যান্ড কমপারেটিভ লিটারেচারের হ্যাগপ কেভোরকিয়ান প্রফেসর

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version