এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের চাহিদা, আয়-ব্যয় ও ঋণের হিসাব মিলাতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। বহুমুখী খাতের চাহিদা মেটাতে খরচের পরিমাণও বেড়ে গেছে। তবে বাড়েনি আয়। ফলে বাড়তি টাকার জোগান দিতে ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বাড়তি ঋণের কারণে আবার মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতির অন্যসব খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা সরকারের আয়-ব্যয়ের সার্বিক হিসাব বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।এ বছরের শেষদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয়ভাবে ও দলীয় সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর।

এছাড়া ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণের চাপ তো আছেই। ভোটারদের মন জয় করতে গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, কমিউনিটি ক্লিনিক সংস্কারকাজ হাতে নিয়েছে সরকার। এসব কাজের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে অর্থছাড় করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি হিসেবেও যেসব অঙ্গীকার রয়েছে সেগুলোর কাজও এখন দ্রুত গতিতে হচ্ছে। এসব খাতে অর্থছাড়ের প্রক্রিয়াও অনেকটা শিথিল করা হয়েছে।

আগে এসব কাজের ব্যাপারে স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগের সম্মতিতে অর্থছাড় করা হতো। এখন আগে চাহিদার ভিত্তিতে অর্থছাড় করা হচ্ছে এবং পরে তাদের মতামত নেয়া হচ্ছে। এসব কারণে সরকারের হিসাব পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক থেকে অর্থছাড়ের চাপ বেড়েছে। যেভাবে অর্থছাড় হচ্ছে সেভাবে সরকারের হিসাবে অর্থ জমা হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকারকে অর্থছাড় করতে হচ্ছে।

এছাড়া সম্প্রতি নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ আর্থিক সহায়তা দেয়ার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এ খাতে ইতিমধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এর বাইরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের (সিএসআর) অংশ হিসেবে বেশকিছু অর্থ এসব খাতে বরাদ্দ করার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের বছরে সরকারের খরচের চাপ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবারের বাজেট প্রণয়নের সময়ই সে বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে। বড় বড় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ আগেই দেয়া হয়েছে। এখন ছোট ছোট উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। তবে বেশিরভাগই যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে না। ফলে একদিকে অর্থ প্রবাহ বাড়ছে, অন্যদিকে এসব অর্থ যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেশ চাপে পড়েছে। সরকারের আয়ের অন্যতম খাত রাজস্ব আহরণ ও বৈদেশিক অনুদান। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আহরণের হার কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বৈদেশিক অনুদানেও টান পড়েছে। গত অর্থবছরে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে বৈদেশিক অনুদান বেড়েছিল আগের বছরের চেয়ে ৯০ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে বৈদেশিক অনুদান এসেছে ৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় ২৬ কোটি ডলার এসেছিল। এই সময় অনুদান বেড়েছিল ৩৮৯ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের একই সময় কমেছে ৭৭ শতাংশ। সরকারের আয় কমলেও সব মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি। ফলে ঋণ করে এসব ব্যয় মেটাতে হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। এই ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে নেয়া ঋণের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা নিজেরা ব্যবহার করেছে। গত অর্থবছরের একই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ শোধ করেছিল প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। গত বছরের চেয়ে এ বছর ৫০০ কোটি টাকা কম পরিশোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বছরের শুরুতে সরকারের ঋণ কিছুটা বাড়ে। বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়লে ঋণ কমে যায়। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ঋণ কমতে পারে। বর্তমানে সরকারি দেনা পরিশোধের চাপের কারণে ঋণ বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরকারি হিসাবে গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের উদ্বৃত্ত ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ কারণে সরকার ওই সময় কোনো ঋণ না নিয়ে বরং আগের ঋণ পরিশোধ করেছে। চলতি অর্থছরে একই সময় সরকারের হিসাবে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান নেই। বরং ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে ঋণের মাধ্যমে।

সরকারি খাতের লেনদেন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) চালু করা হয়েছে। এর আওতায় অনলাইনের মাধ্যমে বেতন ভাতা, বিল পরিশোধ, ছোট ছোট উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের টাকা ছাড় করা হয়। এর মাধ্যমে টাকা ছাড়ের চাপ বেড়ে গেছে।

সরকারের পক্ষে তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব ব্যবস্থাপনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে অনেক স্থানে এ কাজটি করে সরকারি খাতের সোনালী ব্যাংক। সরকার থেকে যে কোনো ব্যয়ের নির্দেশনা বা চেক এলে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সোনালী ব্যাংক ওই অর্থ পরিশোধ করে তাৎক্ষণিকভাবে। সরকারের হিসাবে টাকা না থাকলে ব্যাংক ঋণ সৃষ্টি করে তা পরিশোধ করে।

সোনালী ব্যাংক ঋণ দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক সোনালী ব্যাংককে তা পরিশোধ করে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে চেক এলেও সরকারের হিসাবে টাকা না থাকলেও তারা ঋণ সৃষ্টি করে তা পরিশোধ করে দেয়। এভাবে ঋণ দেয়ার ফলে ঋণের অঙ্ক ১০০ কোটি টাকা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি ট্রেজারি বিল ইস্যু করে।

আগে ৬৬ কোটি টাকা অতিক্রম করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ট্রেজারি বিল ইস্যু করত। ইস্যু করা ট্রেজারি বিল বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়। যতক্ষণ ট্রেজারি বিল বাংলাদেশ ব্যাংক বিক্রি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ হিসাবে থাকে। বিক্রি করে দিলে সেগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ হয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকাকে ‘হাইপাওয়ার্ড মানি’ বা ‘উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন’ অর্থ বলা হয়। এগুলো বাজারে এসে দ্বিগুণ টাকার সৃষ্টি করে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে না চাওয়ায় ট্রেজারি বিলগুলো এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমছে। এই ব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি কমানো হচ্ছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version