এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : পেঁয়াজের বাণিজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ঠকে যাচ্ছেন কৃষক ও ভোক্তারা। লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। সরকারিভাবে বেশ কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও এ সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময় ভোক্তার চাহিদাকে পুঁজি করে পেঁয়াজের দাম কখনও বাড়াচ্ছে, আবার কমাচ্ছে। কিন্তু দেশে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি ভালো থাকার পরও মৌসুমে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে দেশি পেঁয়াজ। এছাড়া যে পেঁয়াজ ভোক্তাপর্যায়ে কেজিতে ৪৫-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সে পেঁয়াজ কৃষক বিক্রি করছেন মাত্র ১০ টাকায়। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়েই ঠকলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, কৃষক পর্যায়ে এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ টাকা। কিন্তু ফড়িয়া ও বেপারী চক্রের কাছে লোকসান দিয়ে এ পেঁয়াজ কৃষকদের বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতি কেজি ১০ টাকা ৯ পয়সায়। তারা আবার বড় পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে ১৩ টাকা ৬১ পয়সায় বিক্রি করছে। পাইকারি বিক্রেতার পর কয়েক হাত ঘুরে এই পেঁয়াজ খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে ২১ টাকা ৩১ পয়সায়। আর জরিপ অনুযায়ী ভোক্তার কাছে খুচরা বিক্রেতাদের এ পেঁয়াজের যৌক্তিক বিক্রয় মূল্য হল ৩০ টাকা। কিন্তু ভোক্তারা এ পেঁয়াজ কিনছেন প্রতি কেজি ৪৫-৫৫ টাকায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মৌসুমের সময় কৃষকরা পেঁয়াজের নায্য মূল্য পাচ্ছেন না। কিন্তু কৃষকের হাতের পেঁয়াজ ফুরালেই সেগুলোর দাম বেড়ে যাচ্ছে। মাঠপর্যায় থেকে পেঁয়াজ ওঠার পরই সিন্ডিকেটের একটি অংশ তা নিয়ে মজুদ করার প্রক্রিয়ায় চলে যায়। পরে তারা সেগুলো ধীরে ধীরে বাজারে ছাড়ে ও দাম বাড়ায়। তখন আর কৃষকের কিছুই করার থাকে না। প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেয় না।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি বিপণন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের সব সময় চেষ্টা থাকছে কৃষক যাতে পেঁয়াজের নায্য মূল্য পায়। তবে দেশে কিছু বাস্তবতা আছে। সব চেয়ে বড় বিষয় হল দেশের কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা অনেক কম। বিশেষ করে পেঁয়াজ বা সবজির মতো পচনশীল পণ্যগুলোর স্টোরেজ করার তেমন কোনো অবকাঠামো নেই। তবে সরকারি কিছু থাকলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যে কারণে কৃষক যখন ফসল উত্তোলন করেন তখন স্টোরেজ করার ব্যবস্থা থাকলে কৃষক পণ্য ধরে রেখে পরে বিক্রি করতে পারতেন।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কৃষকরা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে কখনও হাসির মুখ দেখতে পান না। ফড়িয়াদের কারণে তাদের ফসল উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ভোক্তাদের এ পণ্য উচ্চমূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে কৃষক ও ভোক্তা সব সময় প্রতারিত হন। শুধু লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।

তিনি আরও বলেন, যদি কৃষক থেকে সরাসরি পণ্য বাজারে আনার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের এ তৎপরতায় কখনই লাগাম দেয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া কৃষক থেকে ফড়িয়া ও ভোক্তাপর্যায়ে সরকার সংশ্লিষ্টদের বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এতে কৃষক ও ভোক্তা উপকৃত হবেন। তাহলে কৃষকও তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। আর ভোক্তারাও কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন।

জানা গেছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ২১ লাখ টন। আর বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে আমদানি করা হয় ১০ লাখ টন। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, চাহিদার তুলনায় দেশে ৭ লাখ টন পেঁয়াজ বেশি সরবরাহ থাকে। তবুও দেশের নানা উৎসবের সময় বিশেষ করে কোরবানি ও রোজার ঈদ এলে বিভিন্ন অজুহাতে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা। এছাড়া শীত মৌসুমের শুরু থেকেই দেশের বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করে। তখন পেঁয়াজের দাম সামান্য কমলেও পরে আবার বেড়ে যায়। বর্তমানে বাজারে পর্যাপ্ত পেঁয়াজের সরবরাহ রয়েছে। তারপরও বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায়।

বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই পেঁয়াজ চাষ হয়। তবে প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকৃত জেলাগুলো হল- পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, দিনাজপুর ও রংপুর। দেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ১৪ দশমিক ২৩ লাখ টন। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫৩ লাখ টন।

অন্যদিকে দেশে সারা বছর বারি পেঁয়াজ-১ জাতটি রবি মৌসুমে চাষ হচ্ছে। বারি পেঁয়াজ-২, ৩ ও ৫ জাতটি বিশেষভাবে খরিফ মৌসুমে অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল সময়ে চাষ হচ্ছে।

এছাড়া বারি পেঁয়াজ-৪ একটি উচ্চ ফলনশীল শীতকালীন পেঁয়াজ, যা শীতের সময় চাষ হচ্ছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে আবাদকৃত ৮৭ হাজার ৯৬৬ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৪৯ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। রাজশাহী বিভাগে ৭৫ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে ৮ লাখ ৬০ হাজার ১৪৫ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। রংপুর বিভাগে ১০ হাজার ৬৬৩ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪ হাজার ৭১৯ টন উৎপাদন হয়। খুলনা বিভাগে ২০ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ২২ হাজার ২৯০ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এছাড়া বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৭৩৬ হেক্টর জমিতে ১৩ হাজার ৯১৯, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ হাজার ৬৭৪ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৯৯৬ টন এবং সিলেট বিভাগে ৫৭৮ হেক্টর জমিতে ১৮ হাজার ৬১১ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। তবুও সারা বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ও ভালো ফলন হলেও বছরের বিভিন্ন সময় পেঁয়াজের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের নয়ছয় কমছে না।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক (উপসচিব) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, গত রমজানের সময় অধিদফতরের পক্ষ থেকে পেঁয়াজের মোকাম, পাইকারি ও খুচরা বাজার মনিটরিং করেছি। তখন আমরা ব্যবসায়ীদের পেঁয়াজের বস্তায় মূল্য লিখতে বলেছিলাম। কারণ পেঁয়াজে কোনো মূল্য লেখা থাকলে আমরা ধরতে পারি মোকামে দাম কত ছিল আর পাইকারি ও খুচরায় দাম কত আছে। দামের পার্থক্যটা বের করলেই বোঝা যায় ব্যবসায়ীরা কারসাজি করেছেন কিনা।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বলেন, মোকাম থেকে আমরা সরাসরি পেঁয়াজ কিনতে পারি না। সেখান থেকে কয়েক হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। আমরা বেশি দামে কিনে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করি। তবে পেঁয়াজের দাম বাড়ার পেছনে মোকাম থেকে আমাদের হাত পর্যন্ত আসতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থামছে না। তাদের পকেটে বেশি মুনাফা চলে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাপর্যায়ে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version