এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার আট মাসের মাথায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
সোমবার পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আখতারুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করেন।
একই মামলায় অপর তিন আসামিকেও সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের ব্যক্তিগত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও বিএনপির নেতা সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ব্যক্তিগত সহকারী সচিব মনিরুল ইসলাম।
রায় ঘোষণার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। হারিছ চৌধুরী পলাতক। কারাগারে থাকা অপর দুই আসামি জিয়াউল ও মনিরুল আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছেন আদালত। আর্থিক ক্ষতির ব্যাপারে সহযোগিতার দায়ে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় হারিছ, জিয়াউল ও মনিরুলকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দুদকের পক্ষে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়।
শুনানি চলাকালে গত ২০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ খালেদা জিয়া আদালতে হাজির না হওয়ায় বিচারক তাঁকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। সেদিন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ওই মামলার বিচার কার্যক্রম চলবে বলে বিচারিক আদালত আদেশ দেন। এর বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে ১৪ অক্টোবর হাইকোর্ট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া লিভ টু আপিল করেন। খালেদা জিয়ার করা লিভ টু আপিল আজ সকালে খারিজ করে দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫। ওই সাজার রায়ের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছেন।
খালেদার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের নামে তাঁর তৎকালীন সেনানিবাসের বাড়ির ঠিকানায় নামসর্বস্ব জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। খালেদা জিয়া, তাঁর দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান, ওই ট্রাস্টের ট্রাস্টি হয়েও চ্যারিটেবল কাজে কোনো অর্থ ব্যয় করেননি। বরং নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিগত সময়ে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে অবৈধ প্রভাব খাঁটিয়ে অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করেন। অর্থ পরিচালনায় দায়িত্বরত থেকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ব্যয় করেন তাঁর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। হারিছের ব্যক্তিগত সচিব (পিএস) জিয়াউল ইসলাম এবং সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সহকারী ব্যক্তিগত সচিব (এপিএস) মনিরুল ইসলাম পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারার অপরাধ করেছেন।
২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় ৬ শহীদ মইনুল রোডের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করেন খালেদা জিয়া। চ্যারিটেবল কাজের জন্য ট্রাস্ট করেছেন তা উল্লেখ আছে। কিন্তু চ্যারিটেবল কাজে কোনো টাকা খরচ করেননি। খালেদা জিয়া ট্রাস্টের কাজে তাঁর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের এপিএস জিয়াউল ও অন্যদের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সোনালী ব্যাংক শাখার হিসাবে (অ্যাকাউন্টে) ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে টাকা সংগ্রহ করে লেনদেন করেন। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে টাকা গ্রহণ ও খরচসংক্রান্ত প্রতিটি পদক্ষেপে স্বচ্ছতার অভাব দেখা গেছে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে ক্ষমতার অবৈধ প্রভাব খাঁটিয়ে ১ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জমা করেন। ওই টাকার বৈধ উৎসের কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ওই হিসাবে লেনদেন হলেও প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে যাওয়ার পর ওই হিসাবে আর কোনো লেনদেন হয়নি। খালেদা জিয়া জানতেন, ১ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকার উৎস অবৈধ ছিল। কারণ, তিনি ট্রাস্টের প্রথম ম্যানেজিং ট্রাস্টি। তাঁর অগোচরে ওই ট্রাস্টের হিসাবে টাকা জমা হওয়ার কথা নয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিএনপির তহবিল (ফান্ড) থেকে ৬ কোটি ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৯ টাকা পাওয়ার পরও খালেদা জিয়া জেনেশুনে ৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক দেন। দলের ফান্ডের অতিরিক্ত টাকা অবৈধভাবে সংগৃহীত হিসাবে জমা ছিল, তা তিনি জানতেন। ওই টাকার উৎস অবৈধ। সে কারণে মেট্রোমেকার্স অ্যান্ড ডেভেলপারের ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকাকে বৈধ করার অপচেষ্টা করেছেন। পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা আসামিরা অবৈধভাবে সংগ্রহ করেন এবং খরচ করেন।
হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ
অভিযোগপত্রে বলা হয়, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী অবৈধভাবে অর্জিত সব টাকা নিজ দায়িত্ব সংগ্রহ করে তাঁর এপিএস জিয়াউল ইসলাম এবং সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খানের সহায়তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে অবৈধভাবে জিয়াউর রহমান ট্রাস্টের নামে জমি কেনার জন্য টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন।
জিয়াউল ইসলাম মুন্না যা করেছেন
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর পিএস জিয়াউল ইসলাম মুন্না বিভিন্ন সময় পে-ইন স্লিপের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক শাখায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমা করেন। হারিছ চৌধুরীর নামে অন্য যেসব পে-অর্ডার আসে, তাও তিনি জমা রাখেন। এসব পে-অর্ডার ও নগদ টাকা তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা হিসেবে তাঁরই নির্দেশে অবৈধ টাকা দিয়ে অপরাধ করেছেন।
মনিরুল ইসলাম খান যা করেছেন
মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সহকারী একান্ত সচিব প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে পে–অর্ডার করার জন্য মেট্রোমেকার্স ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এম জাহাঙ্গীর সাহায্যে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখায় যান। পাঁচটি পে–অর্ডারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অ্যাকাউন্টে অবৈধভাবে সংগৃহীত মোট ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারার অপরাধ করেছেন।