বদরুদ্দীন উমর : আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই এখন বলছেন, তারা যে নিরপেক্ষ ও কারচুপিবিহীন নির্বাচন করতে পারেন তার প্রমাণ তারা সম্প্রতি রেখেছেন!
এভাবে বারবার নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের কৃতিত্বের কথা তাদেরকে বারবার বলতে হচ্ছে, কারণ অতীতে তারা নির্বাচনে কারচুপি ছাড়া আর কিছুই করেননি। খোদ নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ দিয়েই তারা নির্বাচনের পর নির্বাচন জয় করেছেন।

২০১৪ সালেও এভাবেই তারা খেলা দেখিয়েছিলেন। এখন জোরেশোরে তারা একথা বললেও কারচুপির মাধ্যমেই তারা খুলনাসহ অন্য মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। সিলেটে তারা পরাজিত হয়েছেন তাদের নিরপেক্ষতার কারণে নয়। সেখানে বিশেষ কতগুলো কারণে তারা অন্য জায়গার মতো কারচুপি করতে পারেননি। এই এক জায়গায় নিজেরা পরাজিত হওয়ার উদাহরণ দেখিয়েই তারা নির্বাচনে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু জনগণ জানেন স্বেচ্ছায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নেই। তাদের অভ্যাসই হল নির্বাচনে সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী সর্বোচ্চ কারচুপি করা।

সংবাদপত্রে এই মর্মে এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রত্যেক আসনে নিজেরাই ডামি বা ভুয়া প্রার্থী খাড়া করার চেষ্টা করবে (Daily Star, 27.10.2018)। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রার্থী না থাকার মতো তাদের কারচুপি নগ্ন অবস্থায় যাতে ধরা না পড়ে তার জন্যই তাদের এই চিন্তা। অবশ্য এই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে যদি বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। এখানে অবশ্য বলা দরকার যে, সরকার তাদের ৭ দফা দাবি না মানলে যদি তারা নির্বাচন বয়কট করে, তাহলে এটা হবে তাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল। বিএনপির ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ২০১৪ সালে নির্বাচন তারা যেভাবে বয়কট করেছিল, সেটাও ছিল তাদের কৌশলগত অপরিপক্কতার উদাহরণ। এবার সে কাজ করলে সংগঠন টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। তাছাড়া নির্বাচন বয়কট করলে আওয়ামী লীগের জয়ই নিশ্চিত করা হবে।

নির্বাচনের আগে বিরোধীদের বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন চালিয়ে আওয়ামী লীগ চাইছে এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে, যাতে বিরোধীরা ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বয়কট করে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তারা ‘সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করে’ ক্ষমতায় ফিরে আসে। এ কারণে তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদেরকে হাজারে হাজারে গ্রেফতার করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদেরকে হয়রানি করছে।

এভাবে তারা গ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে বিরোধীরা কর্মীশূন্য হয়ে পড়ে, নির্বাচনী প্রচারণায় যাতে তারা অংশগ্রহণ না করতে পারে, এমনকি নির্বাচনের সময় পোলিং এজেন্ট দেয়ার মতো লোকও তাদের না থাকে।

বিরোধী দলের সভা-সমিতি-মিছিলের ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদেরকে জনসভা করতে দিচ্ছে না। নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তারা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। পুলিশই এভাবে এখন বাংলাদেশের ‘সংবিধান অনুযায়ী’ দায়িত্ব পালন করছে! এই হল আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মহড়া দেয়ার বৃত্তান্ত!! এসব সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতানেত্রীদের বলতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে!

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কী ধরনের ফ্যাসিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে তার একটা দৃষ্টান্ত হল, শুধু ব্যাপকভাবে গ্রেফতার নয়, বেপরোয়াভাবে মামলা করা। সম্প্রতি তারা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তারপর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছে। শুধু মানহানির মামলা করেই ডা. জাফরুল্লাহকে হেনস্তা করা শেষ হয়নি, তাদের সমর্থকরা জাফরুল্লাহর হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসের ওপর হামলা করে ভাংচুর করেছে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে শুধু মানহানির মামলাই করেনি, তাকে গ্রেফতার পর্যন্ত করেছে!

প্রথমত, মানহানির মামলায় যার ‘মানহানি’ হয়েছে তিনি মামলা করেননি, তার পক্ষে মামলা করেছেন অন্য একজন!! দ্বিতীয়ত, কোনো আইনেই মানহানির মামলার জন্য কারও জেল হয় না এবং আজ পর্যন্ত হয়নি। পেনাল কোডেও এভাবে মানহানির মামলা ও মামলায় গ্রেফতারের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেশের সংবিধান এবং প্রচলিত আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা না করেই জনগণের বিভিন্ন অংশের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশে এখন সরকারসৃষ্ট যে অরাজকতা তৈরি হয়েছে, এর কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত এ দেশে নেই। কিন্তু এ অবস্থাতেও তাদের কোনো পরোয়া নেই। তারা বলেই যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন তারা নিরপেক্ষভাবে করবে এবং জয়ের ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত!

আরেকবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে তার লোকজন প্রতিদিন সভা-সমিতিতে জনগণের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছেন। এসব কথা বলার মালিক আওয়ামী লীগ এবং শোনার মালিক জনগণ। কিন্তু এই আবেদন শোনার পর জনগণ কী করেন সেটা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরা বলছেন, নির্বাচন জিতলে তারা এটা করবেন, ওটা করবেন। এসব কাজ এমন যে এগুলো তাদের ১০ বছরের শাসনকালে তারা করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। যেসব কাজ তারা ১০ বছর গদিতে বসে করেননি, সেগুলো তারা আবার একবার গদিতে বসে করবেন- একথা জনগণ বিশ্বাস করবেন এটা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কীভাবে মনে করতে পারেন?

বিএনপি ও বিরোধী দলের নেতারা কোনো ধোয়া তুলসী পাতা নন। কিন্তু জনগণের এখন সেটা ভাবার সময় নয়। তারা যে শুধু ভোটের অধিকার চান তাই নয়, স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে নির্যাতনের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে তারা বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চান। কাজেই শুধু ভোটের অধিকার নয়, জনগণ এখন চান বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার ও সুযোগ। এ কারণে ভোটের জন্য আওয়ামী লীগের কাতর আবেদনের কথা তাদের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনে জনগণ মোটামুটিভাবে ভোটদানের সুযোগ পেলে এ অবস্থার প্রতিফলন তাদের ভোটের মধ্যে অবশ্যই দেখা যাবে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগের চরিত্র এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের বেপরোয়া কথাবার্তা একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সংবিধান, আদালত, গণতন্ত্র এবং প্রচলিত আচরণ বিধিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের যা মুখে আসে তারা তা-ই বলছে। ক্ষমতায় বসে থেকে তারা কথা বলছে প্রজাদের সামনে জমিদারের মতো! এই জমিদারি তারা কোথায় পেল?

নিজেদেরকে এভাবে জমিদার মনে করায় শুধু জনগণ নয়, বিরোধী দলগুলোকে তারা মনে করছে প্রজা সমিতি। কাজেই বিরোধী দল তাদের সঙ্গে নির্বাচনের মুখে আলাপ-আলোচনার যে আহ্বান জানাচ্ছে, সেটা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে! তবে এর আসল কারণ এ ধরনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো যুক্তিসঙ্গত আলাপ-আলোচনাই সম্ভব নয়। তাদের দলীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী এ ধরনের আচরণের কোনো সুযোগ আর নেই। তারা এখন শুধু জমিদার হিসেবে জনগণকে ও বিরোধী দলকে হুকুম দেয়ার মালিক। প্রজাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

যেহেতু আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন তাদের ছাড়া আর কারও দেশপ্রেম নেই, সে কারণে দেশশাসন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ করবে এটা হতে দেয়া যায় না। এটা হবে দেশবিরোধী কাজ। কাজেই বছরের পর বছর, নির্বাচনের পর নির্বাচন পার হয়ে শুধু আওয়ামী লীগকেই শাসন করতে হবে এই দেশ। তার জন্য নির্বাচন কমিশন, আদালত, প্রশাসন, পুলিশ- সবকিছুকেই নিজেদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে শাসন কাজ চালানো হল দেশপ্রেমেরই একটি অপরিহার্য কাজ। এর জন্য দেশের সংবিধানকেও ইচ্ছেমতো সংশোধন করে করে তাকে ব্যবহার করতে হবে এমনভাবে যাতে বলা যায় যে, তারা যা করছে সবই সংবিধানসম্মত! এভাবেই আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে এমন এক ফাঁদ পেতেছে, যেখানে তাদের দিক থেকে চেষ্টা আছে তাদের এই জমিদারি চিরস্থায়ী করার। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে জনগণের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামকেই তারা ধরে নেয় প্রজা বিদ্রোহ হিসেবে!! এবং এসব প্রজা বিদ্রোহ দমনের জন্য এমন কোনো ফ্যাসিস্ট পন্থা নেই যার ব্যবহার তারা করে না।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। ২৯.১০.২০১৮

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version