এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। ঘা-গুতো খাওয়া ঝানু রাজনীতিক। প্রায় পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা তার রাজনীতির ঝুলিতে। দেশ ও জনগণের প্রত্যাশাও তাই অনেক। রাজনীতির ঝুলিতে এতসব দাপট-কারিশমা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত তরুণ রাজনীতিক মাহিন্দা রাজাপাকসের পাতা ফাঁদেই শেষ পর্যন্ত পা দিলেন। আর এখন একের পর এক টোপ গিলছেন। ২০১৫ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ক্ষমতায় ফেরার নানা জাল ফেলতে থাকেন রাজাপাকসে। অবশেষে ‘ঘুঘু’ ধরা দিল সেই ফাঁদে।

সোমবার টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- ক্ষমতার প্রথম দুই বছরে সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বেশ মাখামাখি সম্পর্ক ছিল। সময় যত গড়ায়, মধুর সম্পর্কও তত তিক্ত হতে থাকে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের শুরু মূলত ২০১৭-এর শুরুর দিকে। সরকার গঠনের পর দুই বছর যেতে না যেতেই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ইস্যুতে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সিরিসেনা আর বিক্রমাসিংহের মধ্যে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক লুটপাটের মতো ঘরোয়া কয়েকটি ইস্যুর মীমাংসায় প্রকাশ্যে লড়াইয়েও দেখা যায়। এটাকেই মোক্ষম সুযোগ হিসেবে লুফে নেন রাজাপাকসে। নিজ দলের এমপি ও কর্মী সমর্থক নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। একটার পর একটা টোপ ফেলতে লাগলেন সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের সম্পর্কের ফাটল আরও বড় করতে। এক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছেন তিনি। চলতি সপ্তাহেই খবর চাউর হয়, হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার বিরুদ্ধে। এটাও ছিল রাজাপাকসের আরেক টোপ। এবার আর ব্যর্থ হয়নি। সোজা গিলে ফেলেছেন। সিরিসেনার সামনে রাজাপাকসের এটাই শেষ টোপ নয়। সিরিসেনার বৌদ্ধধর্মপ্রীতিকেও নিজের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করেছেন রাজাপাকসে। বৌদ্ধ ভিক্ষু আর বৌদ্ধ মন্দিরের প্রতি ভক্তি দেখিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেন তিনি। রাজাপাকসে আগামী দিনে সিরিসেনাকে কোথায় রাখবেন- আজকের মতো ‘মাথার উপরে’ নাকি ‘নাজরের বাইরে’ বিবেচনা দাবি রাখে সে বিষয়টিও। ক্ষমতায় ফিরতে না ফিরতেই আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন রাজাপাকসে। সেই ডাকে আবার সম্মতিও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রোববার নিজের প্রথম ভাষণে আগাম নির্বাচনের ডাক দেন রাজাপাকসে। বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব দেশে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন দেয়া হবে। আয়োজন করা হবে সংসদ নির্বাচনেরও।’ একদিন পরই আগাম নির্বাচনের ডাকে রাজাপাকসের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সিরিসেনা। সোমবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, ‘যত দ্রুতই প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ আগাম নির্বাচনের ডাকও রাজাপাকসে আরেক টোপ বা শেষ টোপ কিনা তা সময় গড়ালেই স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

এদিকে গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলংকা। দেশটির এই সংকটে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে প্রধান দুই আঞ্চলিক শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যকার যে ছায়াযুদ্ধ তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। একদিকে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ মালদ্বীপের মতোই কলম্বোয় প্রভাব বিস্তারে মরিয়া নয়াদিল্লি। অন্যদিকে প্রভাব বিস্তারের খেলায় মালদ্বীপের হার শ্রীলংকায় পুষিয়ে নিতে চায় বেইজিং। মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে পরাজয় হয়েছে দেশটির চীনপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের। শ্রীলংকায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন চীনপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন সংকটের মধ্যদিয়ে শ্রীলংকা ক্রমেই ভারত থেকে সরে চীনের ঘনিষ্ঠ হবে। ব্লুমবার্গের সোমবারের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

শুক্রবার থেকেই শ্রীলংকার রাজনীতিতে ঘটতে থাকে নাটকীয় পরিবর্তন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে। সরকারের তিন বছরের মাথায় তাকে বরখাস্ত করে রাজাপাকসেকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। এতে শ্রীলংকার রাজনীতি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে এক ধাপ এগিয়ে গেছে চীন। কারণ তার আগের মেয়াদেই শ্রীলংকায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল চীন। বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মহলে রাজাপাকসের অনেক বন্ধু। রাজাপাকসে পরিবারেও চীনের শুভাকাক্সক্ষী কম নয়। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় রাজাপাকসেকে অভিনন্দন জানিয়েছে চীন। শ্রীলংকায় চীনের রাষ্ট্রদূত চেং জুইয়ান গতকাল সন্ধ্যায় কলম্বোয় রাজাপাকসের বাসভবনে গিয়ে তাকে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দেন। সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রদূত শ্রীলংকায় আগামী দিনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে চীনের ব্যাপক সমর্থন থাকবে বলে আশ্বাস দেন। রাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা ইউরেশিয়া গ্র“পের পরিচালক (এশিয়া) শৈলেশ কুমার বলেন, সিরিসেনা তার রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে রাজাপাকসেকে এনেছেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version