এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচন সামনে রেখে জটিলতা দূর করতে প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের সংলাপ ইতিবাচক। এক টেবিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে দেশ ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় মানুষের মাঝে বহু কাক্সিক্ষত স্বস্তি ফিরে আসবে।

তবে সব পক্ষের ছাড় দেয়ার মানসিকতার ওপের নির্ভর করবে সংলাপের সফলতা। ছাড়ের মধ্যেই আছে সমস্যার সমাধান। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণে ছাড়ের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।

তারা বলেন, সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে প্রথম বৈঠককে সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এক বৈঠকেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এটা আশা করাও বাতুলতা। তাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আরও সংলাপ হতে হবে।

আশার কথা হল, রুদ্ধদ্বার কক্ষে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সংলাপ হতে পারে বলে শুনছি। কিন্তু তাতেও যদি সমাধান না হয়, তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার শঙ্কা আছে। এতে ভবিষ্যতে দেশ আরও বড় সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। কাজেই উভয়পক্ষের আরও বেশি সাবধান হওয়া উচিত।

শুক্রবার টেলিফোনে আলাপকালে দেশের সিনিয়র নাগরিকরা আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর এ সংলাপ আমাদের কাছে বহু কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত। বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে রাজনৈতিক দলের নেতারা এক টেবিলে বসে আলাপ করছেন এ দৃশ্য দেখে আমরাসহ দেশের মানুষ খুব খুশি হয়েছি। সাধারণ মানুষ চান তারা ভোট দিয়ে তাদের সরকার গঠন করবে। যারা জয়লাভ করবে তারা দেশ শাসন করবে। এজন্য দরকার সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ ক্ষেত্রে অন্তরায় চিহ্নিত করে তা দূর করতে হবে। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কথা শুনতে ও বুঝতে চায় না। এ নির্বাচনের ওপর বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবর্মূর্তি নির্ভর করছে।

তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মারপ্যাঁচের কথায় যেন আসল জিনিস হারিয়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। মানুষের প্রয়োজনে দেশ, আইন ও সংবিধান। মানুষের এ প্রয়োজনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেও তারা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।

পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সা’দাত হুসাইন বলেন, একদিন শুধু সংলাপ হয়েছে। কোনোভাবেই মনে করা উচিত নয় যে, একদিনের সংলাপের মাধ্যমেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। একেবারে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ পরিষ্কার হয়েছে। এজন্য সময় লাগবে। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ১৪ দলের মধ্যে বৃহস্পতিবারের সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ এসেছে।

তিনি বলেন, সমস্যার যদি সমাধান করতে হয় তাহলে আলোচনায় যেতে হবে। আলোচনা ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। আরেকটি উপায় হচ্ছে, আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু তাতে এক দল পরাজিত হয়ে যায়, আরেক দল তখন দখল করে। সেটা কিন্তু অন্য ধরনের সমস্যা, অন্য ধরনের সমাধান। আমি মনে করি, সংলাপের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা এখন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন। কিন্তু সফল কখন হবেন তা চট করে বলা যাবে না।

তিনি বলেন, হাটে-বাজারে-গাড়িতে যেখানেই কথা বলেন সবাই কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কথা বলছেন। যেটা ড. কামাল হোসেন অনেক দিন থেকে বলে আসছিলেন, কিন্তু কেউ পাত্তা দিচ্ছিলেন না। এখন কিন্তু মানুষ শুনছে। লোকে তাদের দিকে তাকাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এ সংলাপে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে, দুটি পক্ষের অনমনীয় অবস্থানের বরফ গলেছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে বলে শুনছি। কোনো তর্ক-বিতর্ক হয়নি। এটা দেশ এবং গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। অতীতের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছিল, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ছিল আস্থা অর্জন। এ সংলাপ আমাদের সেদিকে হয়তো নিয়ে যাবে। তবে পুরাপুরি সমাধানের জন্য আরও দু-একটি আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে। তাই আমরা চাইব, এ সংলাপের পথ যেন বন্ধ না হয়। তফসিলের পরও সংলাপ হতে পারে। তফসিল সংলাপের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। উভয়পক্ষ আরও আলোচনায় বসলে সমাধানের পথ বের হবেই।

এ শিক্ষাবিদ বলেন, সাংবিধানিক কারণে ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি মেনে নেয়া অসম্ভব বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষে সব দাবি পুরোপুরি মেনে নেয়া সম্ভব নয় বলে মনে হচ্ছে। কেননা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় মনে হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার এবং ইসি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে হয়তো সরকারি পক্ষ ছাড় দেবে না। তবে সংবিধানের মধ্যে থেকেও যদি ঐক্যফ্রন্ট এবং যুক্তফ্রন্ট থেকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তাহলে সেভাবে সমাধানের পথ বের হতে পারে।

তিনি বলেন- এটা ইতিবাচক যে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মামলা-হামলার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়েছে। এখন আশা করা যায় নির্বাচন পর্যন্ত এসব কমে যাবে। রাজবন্দিরা হয়তো মুক্তি পাবেন। নির্বাচনী মাঠ সমান করার ক্ষেত্রে এটা একটা অগ্রগতি। সাত দফা দাবির মধ্যে সংসদ থাকা না থাকা এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টিও হয়তো সরকার চাইলে নিষ্পত্তি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বড় বাধা রয়ে যাবে খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে। এটা আসলেই এখন সরকারের হাতে নেই, আদালতের বিষয়।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ চায় নিষ্পত্তিযোগ্য বিষয়ে সব পক্ষের ছাড়ের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন। আন্তর্জাতিক মহলও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, কেউ কেউ হয়তো চাইবে না জটিলতার নিষ্পত্তি। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে যে, ক্ষতিটা তাদেরই বেশি হবে। অনমনীয় অবস্থানে থেকে নির্বাচনে না গেলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে। বিপরীত দিকে সংলাপ ডেকে সরকার একটি বাহবা নিয়েছে। কিন্তু আর সংলাপে না বসলে সরকারেরও বলার কিছু থাকবে না।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ১৪ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সংলাপ নয় একটি আলোচনা সভা হয়েছে। যেখানে একদিকে দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে দাবি নাকচ করা হয়েছে। সংলাপ তো হয় বিষয়ভিত্তিক। সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের অধিকার দেয়া, নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেয়া এবং গায়েবিসহ রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার- এ তিনটি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। দেখুন, সভা-সমাবেশ তো আমাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। এটি মেনে নেয়ার বিষয়ই নয়। আর কোনো সভ্য দেশে গায়েবি মামলা হয় বলে আমার জানা নেই। নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণ তো সম্ভবই নয়। কারণ সময়ই তো নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেষ্টা করেছে, তাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, সংলাপের মূল বিষয় হওয়ার উচিত তিনটি। প্রথমত, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারকে পক্ষপাতহীন রাখা। তারা যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে তাহলে তো সুষ্ঠু নির্বাচনই সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, সংসদ বহাল রেখে সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে না। তাই সংসদ ভেঙে দেয়া। তিনি বলেন, আশার কথা হল রুদ্ধদ্বার কক্ষে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সংলাপ হতে পারে বলে শুনছি। তাতেও যদি সমাধান না হয় পরিণতি ভালো নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দেশ আরও চরম সংকটের মধ্যে পড়ার শঙ্কা আছে।

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এ সংলাপে জনগণের কতটা লাভ হয়েছে, সেটা এখনও বলার সময় আসেনি। তবে এ সংলাপে টানেলের শেষ মাথার আলোর রেখা দেখতে পাই। এখন সেই আলোর কাছে পৌঁছাতে পারব কিনা সেটা নির্ভর করবে সব পক্ষের সদিচ্ছার ওপর।

আমি বলতে চাই যে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মানুষের অনেক আশা। সাধারণ মানুষ চায় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যেখানে সব দলই শুধু অংশ নেবে না, সব ভোটার নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে। সংখ্যালঘু, নারী, যুবক, বয়স্কসহ সব ভোটার চান নির্বাচনের আগে ও পরে কোনো সহিংসতা হবে না। এসব নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের পক্ষে এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গগুলোরও এক্ষেত্রে দায়িত্ব আছে।

শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের এ নেত্রী বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন দাবি আছে। সে সবের ব্যাপারে সংবিধানে কী আছে বা নেই- সে কথাও আমরা শুনছি। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে। কিন্তু চায়ের দোকান, রাস্তার পাশের আড্ডা, ফেসবুক সর্বত্রই আলোচনা আসন্ন নির্বাচন। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মারপ্যাঁচের কথার ধার ধারে না সাধারণ মানুষ। তারা একটি জিনিসই চান- শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। মনে রাখতে হবে, এ নির্বাচনের ওপর বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নির্ভর করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মারপ্যাঁচের কথায় যেন আসল জিনিস হারিয়ে না যায়।

আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হল দেশের রাজনীতি এখন অনেক বেশি পরিপক্ক। এমন আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনীতি আরও অনেক বেশি সুন্দর ও গঠনমূলক জায়গায় যাবে বলে মনে করি। রাজনীতিতে আলাপ-আলোচনা করে, সংলাপ করে কেউ দুটা ছাড় দেবে, কেউ তিনটা ছাড় দেবে। এটি করেই তো দেশকে এগিয়ে নেব। এ জায়গায় আসতে আমাদের ৫০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে গেছে। তবু আমি খুব আশাবাদী যে, আজকে আমরা এ জায়গায় এসেছি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version