এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘জনগণ ভোট দেয়ার পরিবেশ চায়, অবাধে ভোট দিতে চায়। এ কাজটি একমাত্র আপনিই নিশ্চিত করতে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) সফল সংলাপের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারেন। আর সেটা সম্ভব হলে আপনার এই উদারনৈতিক অবদানটিই বিশ্বের বড়মাপের নেতাদের মতো আপনাকে অমর করে রাখবে।’
ড. কামাল হোসেন এ সময় বঙ্গবন্ধুর পথ অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করারও অনুরোধ জানান।
বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সূচনা বক্তব্যের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ড. কামাল হোসেন।
এ সময় নিজেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ক্ষুদ্র অনুসারী দাবি করে তিনি বলেন, ‘এটাও আপনার অজানা নয় যে, কোনো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়লে তা নিয়ে আলোচনা করাও সংবিধানসম্মত। কারণ সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেরই অংশ। বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানসম্মত একাধিক পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি।’
ড. কামাল হোসেন তার বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় আপনাকে এবং আপনার দল ও জোটের সহকর্মীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি দৃপ্ত অঙ্গীকার করার জন্য। যেখানে আপনি বলেছেন, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সব বিষয়ে আলোচনার জন্য আপনার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এ কথায় আমাদের মতো অনেকেই, বিশেষ করে দেশবাসী আশ্বস্ত এবং বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছেন। আপনি অবগত আছেন যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত মহান স্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য ছিল, সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সংবিধানের প্রাধান্য’কে সমুন্নত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ, সংবিধানের এই ঘোষণার সঙ্গে বাক্-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও সমাবেশের স্বাধীনতা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করাই হল জনগণের মালিকানা নিশ্চিত হওয়া। তবে আমরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করছি, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বিচারে গ্রেফতার, গায়েবি ও হয়রানিমূলক হাজার হাজার মামলা দায়ের, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত প্রাণনাশ এবং অন্যান্য বহুবিধ অন্যায় ও অবিচার ঘটে চলেছে। এসব অনতিবিলম্বে বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারের আশু ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এটা অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য পূর্বশর্ত।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বলা হয় আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাসে সংলাপ আনুষ্ঠানিকভাবে সফল না হলেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় স্বার্থে সমঝোতা বা একটা আপসমূলক অবস্থায় পৌঁছানোর নজির আমাদের আছে। বিএনপি গোড়াতে না চাইলেও আপনার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার সংবিধানে যুক্ত করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমরা জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক যেসব কারণে এখানে হাজির হয়েছি, সেসব নীতিগত কারণে সাম্প্রতিক অতীতেও আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের সহযোদ্ধা ছিলাম। নির্বাচনকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর পল্টনের ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ১১ দল, জাসদ, ন্যাপ নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের যে লিখিত রূপরেখা দিয়েছিল, তার মধ্যকার কিছু মৌলিক বিষয় আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আপনি সংবিধানসম্মত সমাধানে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এটাও আপনার অজানা নয় যে, কোনো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়লে তা নিয়ে আলোচনা করাও সংবিধানসম্মত। কারণ সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেরই অংশ। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানসম্মত একাধিক পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি।’
তিনি এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ‘এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের সাত দফার পাশাপাশি ১৩তম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিমকোর্টের দেয়া রায়ের আলোকে বিশেষ করে দশম ও একাদশ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করা, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা, ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানে আপনার প্রস্তাবের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’
ড. কমাল হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের (খ) উপদফায় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা এবং সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের বিধান রয়েছে। সুতরাং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত এবং তা ওয়েস্টমিনিস্টার মডেলের সংসদীয় রীতি মেনে চলা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অনুশীলনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের নির্বাচন ব্যতিরেকে এর আগের নয়টি সংসদ নির্বাচন সংসদ ভেঙে দেয়া অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ এ সময় স্মৃতিচারণ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বঙ্গবন্ধু সংসদের সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের বুকে তারা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, আজকের আলোচনায় আপনি আমাদের যথাযথভাবে আশ্বস্ত করলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও তার সামর্থ্য বৃদ্ধিকল্পে সংবিধানসম্মত একাধিক নির্দিষ্ট প্রস্তাব দ্রুততম সময়ে আমরা আপনার সদয় বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির লক্ষ্য হল দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণ সাধন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জনগণের শক্তিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আপনিও জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও জনগণের কথা বলতে এসেছি। জনগণ ভোট দেয়ার পরিবেশ চায়, অবাধে ভোট দিতে চায়।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আজ যুব দিবস। তাই বিশেষভাবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, ইতিমধ্যে মোট ভোটারের অধিকাংশ যুবক। গত এক দশকেই সোয়া দুই কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। আমরা তাদের হতাশ করতে চাই না।’
প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, ‘পরিশেষে বলব, দেশ পরিচালনার যে ঐতিহাসিক সুযোগ আপনি পেয়েছেন, সেখানে জাতীয় ঐক্য এবং রিকন্সিলিয়শন বা মেলবন্ধনে কতটা কার্যকর ভূমিকা আপনি রেখে যেতে পারছেন, আগামী দিনের মানুষ যুগ যুগ ধরে সেটাই মনে রাখবে। নেলসন মান্ডেলার মতো রাজনীতিকদের সারা বিশ্ব শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে একটি বিবদমান ও সংঘাতপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘জীবন সায়াহ্নে বঙ্গবন্ধুর একজন ক্ষুদ্র অনুসারী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, জাতীয় মেলবন্ধনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনা সম্ভব হলে তার ইতিবাচক প্রভাব জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ সবকিছুর ওপরই পড়বে। এই লক্ষ্য অর্জনে আপনি সম্ভব সব ধরনের পদক্ষেপ নিন। জাতির ইতিহাসে আপনার নাম সোনার হরফে লেখা থাকবে।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ তার দলের নেতাদের প্রতি শুভকামনা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।