এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করতে পারলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।

শুক্রবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট নেতাদের সংলাপের পর বারিধারার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন মন্তব্য করেন। এর আগে তিন ঘণ্টা সংলাপ শেষে গণভবন থেকে বের হয়ে তিনি বলেছেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। আরও আলোচনা হবে।

এদিকে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে গঠনমূলক ও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠক শেষে গণভবন থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তাদের দেখে অত্যন্ত ইতিবাচক মনে হয়েছে। আমরা মনে করি, তারা নির্বাচনে আসবে। কারণ আমরা তাদের অনেক দাবি মেনে নিয়েছি।

এর আগে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে যুক্তফ্রন্ট নেতাদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকলে দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, আমরা সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চাই, যাতে জনগণ তাদের নেতৃত্ব খুঁজে নিতে পারে। কিভাবে তা খুঁজে নিতে পারে সেটাই লক্ষ্য।

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও বাধা অতিক্রম করে আমরা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রেখেছি। জনগণের কল্যাণে কাজ করছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক এটাই আমরা চাই।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ধারা অব্যাহত থাকুক এবং উন্নয়নের গতি সচল থাকুক। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে সংলাপের পরদিন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে এ সংলাপ হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বি. চৌধুরী বলেন, সরকার যুক্তফ্রন্টের সব দাবি বাস্তব বলে মেনে নিয়েছে। এখন বাস্তবায়ন করবে কিনা সেটা সরকারের ব্যাপার। আমরা দেখব সরকার বাস্তবায়ন করে কিনা। সংলাপ আন্তরিকভাবে হয়েছে। সরকার যদি কথা রাখে তাহলে আশাবাদী।

বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, যদি সরকারকে নিরপেক্ষকরণ করা যায় এবং নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতির অধীনে ও সরকার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকতে পারে, তাহলে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরিবেশ সৃষ্টি হলে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করব।

সংলাপের বিষয়ে তিনি বলেন, জনগণের পক্ষ থেকে দাবিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তফ্রন্টের সব দাবি যুক্তিপূর্ণ। এগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে তারা একমত পোষণ করেননি।

বি. চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেয়া সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার দাবি জানিয়েছি। এজন্য সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দাবিটা যুক্তিসঙ্গত। এছাড়া নির্বাচন কমিশনকে শতভাগ রাষ্ট্রপতির অধীনস্ত করতে হবে। তারা বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত করা হবে। সরকারের অধীনে থাকবে না। এ ব্যাপারে তাদের দ্বিমত নেই।

অন্যদিকে তফসিল ঘোষণার পর এমপিরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে না এবং উন্নয়ন প্রতিশ্র“তি দিতে পারবেন না বলে দাবি জানিয়েছি। এক্ষেত্রে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) নীতিগত সম্মতি দিয়েছেন।

তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের বিলবোর্ড, ব্যানার অবিলম্বে অপসারণের দাবি জানানো হয়েছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিলবোর্ডের ব্যাপারে তারা নিজেরাই ক্লান্ত। সুন্দর সুন্দর চেহারা দেখানোর জন্য বিলবোর্ড ছাপাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিলবোর্ড থাকবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

তবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের ক্ষমতা সীমিত করা হবে এবং নিরপেক্ষতা বজার রাখা হবে। সেনাবাহিনী মোতায়েন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে।

তবে উপজেলা অঞ্চলে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে তারা যাবে। তবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে আমরা এমন কোনো ক্ষমতা দিতে চাই না, যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

ইভিএম সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইভিএম সরকারের হাতে নেই। এটা নির্বাচন কমিশন ও রাষ্ট্রপতির অধীনে। এ নিয়ে অর্ডিন্যান্স হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলবেন। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এ ধরনের আটক ব্যক্তিদের তালিকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

সংবাদ সম্মেলনের শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, গঠনমূলক ও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। উভয়পক্ষই প্রাণবন্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছে। তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় শুধু নির্বাচনই নয়, সুশাসনের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। যুক্তফ্রন্টের বেশিরভাগ দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী সম্মতি জানিয়েছেন।

মহাসচিব আবদুল মান্নান বলেন, যুক্তফ্রন্টের ৮ দলের ২১ জন প্রতিনিধি সংলাপে অংশ নেন। ৫টি দাবি ও ২১টি লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জনগণের দাবিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি।

গণভবন থেকে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তারা যে দাবিগুলো তুলেছে তার সঙ্গে উভয়পক্ষেরই অনেক মিল ছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গেও অভিন্ন মত এসেছে। এছাড়া আলোচনায় সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে এমন কোনো দাবি যুক্তফ্রন্ট করেনি বলেও জানান তিনি।

আলোচনা প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, সংলাপে আমাদের মাত্র দু’জন নেতা আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ এবং ১৪ দলের মাঈনুদ্দীন খান বাদল আমাদের এদিক থেকে কথা বলেছেন।

আলোচনার পুরোটাই মূলত যুক্তফ্রন্ট নেতারা ডমিনেট করেছেন। তাদের একজন বাদে বাকি ১৯ জন নেতাই কথা বলেছেন। তারা যা কিছু বলতে চেয়েছেন সব কিছুই আমাদের লিডার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তিনি তার বক্তব্যে দাবির বেশিরভাগই মেনে নিয়েছেন।

এর আগে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে গণভবনে যান বদরুদ্দোজা চৌধুরী। গণভবনে ঢুকে ওবায়দুল কাদেরসহ উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। পরে সংলাপের জন্য ব্যাংকোয়েট হলের নির্ধারিত আসনে বসেন।

প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যা ৭টা ৪২ মিনিটে হলে প্রবেশ করেন। এ সময় বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও শমসের মবিন চৌধুরী তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। পরে প্রধানমন্ত্রী তার সূচনা বক্তব্যের শুরুতে গণভবনে আসার জন্য যুক্তফ্রন্ট নেতাদের স্বাগত ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, গণভবন জনগণের ভবন। আপনারা এখানে এসেছেন এ জন্য ধন্যবাদ জানাই।

যুক্তফ্রন্ট প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হলেন- বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান, প্রেসিডিয়াম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরী, গোলাম সারোয়ার মিলন, আবদুর রউফ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মুহম্মদ ইউসুফ, সহসভাপতি মাহমুদা চৌধুরী, মাহবুব আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক ওমর ফারুক এবং নির্বাহী সদস্য মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী।

এছাড়া সাবেক এমপি এইচএম গোলাম রেজা, বিএলডিপির সভাপতি নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ ন্যাপের সভাপতি জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান (এনডিপি) খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তুজা, মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ইশা, বাংলাদেশ জনতা পার্টির সভাপতি শেখ আসাদুজ্জামান, জনদলের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান জয় চৌধুরী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইউনাইটেড মাইনরিটি ফ্রন্টের সভাপতি দিলীপ কুমার দাশ এবং লেবার পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হামদুল্লাহ আল মেহেদী উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংলাপে ২৩ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন- আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্যাহ, আবদুল মতিন খসরু, আবদুর রাজ্জাক, রমেশ চন্দ্র সেন, আনিসুল হক, মাহাবুবউল আলম হানিফ, আবদুর রহমান, দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুস সোবহান গোলাপ, শ ম রেজাউল করিম, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, মাঈনুদ্দীন খান বাদল ও সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে গত ৩০ অক্টোবর চিঠি দেন বদরুদ্দোজা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সাড়া দেন। পরে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল রাত সাড়ে ১০টায় বারিধারার বাসভবন মায়াবীতে গিয়ে সংলাপের আমন্ত্রণপত্র বি. চৌধুরীর কাছে হস্তান্তর করেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version