বিশেষ প্রতিনিধিঃ দুই সপ্তাহ কারাগারে কেটে গেল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাদন্ড প্রাপ্ত হওয়ায় তাকে গত ৮ ফেব্রুয়ারী কারাবন্দী করা হয়। তার মুক্তি দাবিতে হরেক রকমের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর দল বিএনপি। রায়ের আগে লন্ডন থেকে গরম কর্মসূচি শুরু হলেও ক্রমেই শীতল হচ্ছে দলটির কর্মসূচি। সরকার উচ্ছেদের নানাবিধ হুমকি, ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভের পথ মাড়িয়ে মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর শেষে আবার সরকারের কাছেই স্মারকলিপি দিয়েছে দলটি। এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারান্তরীণ রেখেও সরকার রয়েছে হার্ডলাইনে। সতর্ক রাখা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। ইতোমধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সাবেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নজরদারিতে রাখা হয়েছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক ছাত্রনেতাদের। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়া তারেক রহমানের গতিবিধির ওপর রাখা হয়েছে স্পেশাল সতর্কতা।

গত ৮ ফেব্রুয়ারী বিশেষ আদালতে বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ডের রায় দেয়া হলে তাকে সরাসরি পুরোনো ঢাকার কারাগারে অন্তরীণ করা হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারী রায়ের কপি হাতে পান বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। ২০ ফেব্রুয়ারী জামিন আবেদন করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে আবেদন গ্রহণ করে শুনানির জন্য উচ্চ আদালত তারিখ নির্ধারণ করেছেন ২৫ ফেব্রুয়ারী। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর কারাজীবন ও জামিনের পরিস্থিতি-ই আগামী নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণ করবে বলে মনে করছেন সবাই।

বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে ১২ ফেব্রুয়ারী মানববন্ধন, ১৩ ফেব্রুয়ারী অবস্থান ধর্মঘট ও ১৪ ফ্রেুবয়ারী গণঅনশন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি গণস্বাক্ষর অভিযান, ১৮ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালন করেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি দলটি ঢাকা ব্যতিত সব জেলা এবং মহানগরীতে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারী রাজধানীতে সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হলেও অনুমতি না পাওয়ায় ২৪ ফেব্রুয়ারী শনিবার রাজধানীতে কালো পাতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি। এরপর কেন্দ্রীয় নেতাদের জেলা সফরসহ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে বলে দলটির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিড্ওি কনফারেন্সের মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটি, সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেছেন। তবে তার বক্তব্য প্রকাশ/প্রচারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি জনগণের কাছে পৌঁছতে পারছেন না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের কোনো উপস্থিতি না থাকায় তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ভিড্ওি কনফারেন্সের রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। পক্ষান্তরে, সরকারের পক্ষ থেকে তার সবধরণের কার্যক্রমকে ক্রমশ সীমিত করতে নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে বিএনপির অভিযোগ। খোদ দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন।

দৃশ্যত বিএনপি প্রকাশ্য কর্মসূচি অব্যাহত রাখলেও প্রতিনিয়তই গ্রেফতার করা হচ্ছে ডেডিকেটেড নেতাদের। খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সম্প্রতি গ্রেফতার করা হয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান, নাজিম উদ্দিন আলম, আজিজুল বারী হেলাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাসান মামুন ও ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি রাজিব হাসান সহ কয়েকডজন নেতাকে। বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা মিললেও কার্যত পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাবিব উন নবী খান সোহেল, শফিউল বারী বাবু, সাইফুল আলম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ সাবেক গুরুত্বপূর্ণ সব ছাত্রনেতা।

এদিকে, দুর্নীতি মামলার সম্ভাব্য রায় নিয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনায়ও সরকারের প্রধান টার্গেটে সাবেক ছাত্রনেতারা। যুক্তরাজ্য বিএনপির ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচি থেকে এ হামলা চালানো হলেও নির্দেশদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগের অভিযোগের আঙ্গুল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দিকে। তিনি-ই এ হামলার নির্দেশদাতা অভিযোগ করে ইতোমধ্যে তার বিচারের দাবি জানিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। আর হামলাকারী হিসেবে বেশকিছু সাবেক ছাত্রদল নেতাকে তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। গ্রেফতারকৃত সাবেক ছাত্রনেতা ও ইউকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাসির আহমেদ শাহীন মুক্তি পেয়েছেন। তবে এ নিয়ে দু‘দিক দিয়েই ফেঁসে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের বিএনপি, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতারা। হাইকমিশনের গেইটের বাইরে ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত কয়েকজনকে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বৃটিশ পুলিশ। কমিশনের বাইরের ঘটনার তদন্ত করছে বৃটিশ পুলিশ। আর হাইকমিশনের ভেতরে ভাংচুরের ঘটনার বিচার করবে বাংলাদেশ সরকার।

সূত্র জানায়, হামলায় নেতৃত্বদানকারী কয়েকজনকে ইতোমধ্যে তালিকাভুক্ত করেছে দুতাবাসের কর্মকর্তারা। তাদের বিস্তারিত তথ্য ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কাছে পৌঁছাছে। এদের মধ্যে আছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও ইউকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নাসির আহমেদ শাহীন, সাবেক ছাত্রনেতা শরফরাজ শরফু, ইউকে যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক সুহেদুল হাসান, ইউকে সেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ, মোঃ আব্দুল্লা আল মামুন, মোঃ তোফাজ্জল হোসাইন , এডভোকেট এনাম আসগর, মাছুম বিল্লাহ, হুমায়ুন কবির, নাজিম উদ্দিন দোদন, আরিফ হোসাইন, আবদুল কাদির নাজিম, আবদুর রহিম, রাজু আহমেদ, মোঃ খালেদ মাহামুদ রাকিব ,ইউকে স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক আব্বাসউল্লাহ , মোঃ নিজাম উদ্দিন, মোঃ মাহফুজ আহমেদ, মোঃ রাসেল মাহমুদ, মোঃ সালাহ উদ্দিন, হাবিবুর রহমান, ইস্ট লন্ডন বিএনপি নেতা মনজুরুল ইসলাম, যুবদল নেতা মোঃ সাকোয়াত হোসেন, পারভেজ আহমেদ রাকিব, খুলনা জেলা বিএনপি‘র সমাজ কল্যান বিষয়ক সম্পাদক মঞ্জুর হাসান, মোহাম্মাদ মাসুদুল ইসলাম খাঁন,মোঃ মহিন উদ্দিন, সেচ্ছাসেবক দলের মোঃ আরিফুর রহমান খান, মোহাম্মাদ সাদেকুর রহমান, ইস্ট লন্ডন বিএনপি নেতা আল নাহিয়ান বিন মুরাদ, সাইফুর রহমান, মোঃ তানজিল ইসলাম,স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ সভাপতি মোঃ আশিকুল ইসলাম,সাবেক ছাত্রনেতা এম এ শামিম, জামাল মিয়া, মোঃ রিফাত মাহমুদ ভূঁইয়া , নিউহ্যাম বিএনপির সহ সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মোঃ ইলিয়াস শাহ্ , সালমান সাদী , সৈয়দ তারেক আহমদ , যুক্তরাজ্যে সেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক মোঃ জাহেদুর রহমান চৌধুরী ওরফে মুহাম্মাদ জামাল উদ্দিন, মো: আব্দুল মুকিত রাজিব, সাবেক শিবির নেতা নউসিন মোস্তারী মিয়া সাহেব, সায়েম আহমেদ, মোঃ রিফাত মাহমুদ ভূঁইয়া, হাসান মোর্শেদ, আবদুল্লাহ সিদ্দিকী, লন্ডন মহানগর বিএনপি নেতা অলিউর রহমান, মোঃ মিজানুর রহমান ফারমান, যুবদল নেতা কাজী তাজ উদ্দিন আহমেদ, ফজলে রহমান পিনাক, সাবেক ছাত্রনেতা শেখ কামরুজ্জামান,, এ এ ওয়াহিদুল ইসলাম, মোঃ কবির উদ্দিন, শেখ আলমগীর, লাকি আহমেদ, মিজানুর রহমান, জোবায়ের ইসলাম শিশির।

যদিও বৃটিশ আইনে হামলার দায় থেকে রক্ষা পেতে ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক ও সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ এই হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন। এই বিবৃতি প্রদানের মাধ্যমে তারা বৃটিশ পুলিশের তদন্তের কাজকে যেমন সহজ করে দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের জন্যও এখন দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা সহজতর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারন এই হামলায় শুধু দূতাবাসের সম্পদ নয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ভাংচুর করা হয়েছে। যে কারনে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে। একইসঙ্গে কয়েকজনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এই হামলার বিচার দাবিতে দেশ-বিদেশে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গদলগুলো। ১৬ ফেব্রুয়ারী জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে লন্ডন দূতাবাসে হামলাকারীদের নাগরিকত্ব বাতিল ও তাদের দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের দাবি জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ। একই দাবি উঠেছে লন্ডন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থেকেও।

এদিকে, দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কার্যতঃ সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ ফেব্রুয়ারী এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এর আগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় বিভিন্ন মহল থেকে ফোনে তদ্বির আসলেও এবার বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারাবন্দীর ঘটনায় কোনো ফোন আসেনি। হয়তো দুর্নীতির বিচারের বিষয়ে কারো আপত্তি নেই। আমি অনেক বিশ্বনেতাদের সাথে বৈঠক করলাম তারাও এ বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

বিএনপির তৃনমূলের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বক্তব্যের পর অনেকটা হতাশ। স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ফরিদ উদ্দীন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, কঠোর কর্মসূচি ছাড়া নেত্রীকে মুক্ত করা সম্ভব হবে না। তৃনমূল চায় দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করতে। সেখানে নরম কর্মসূচি দিয়ে সরকারের অনুমতির পেছনে ছুটে চলায় কার্যত কোনো ফল আসছে না। বিএনপির অনলাইনে সক্রিয় নেতাকর্মীদের মতামতও এরকমই।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version