এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না- নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরেও এটা এক কঠিন প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বৃহস্পতিবার কারাআদালত ত্যাগের আগে নির্বাচনে যেতে সবুজ সংকেত দিয়েছেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তার সত্যতা স্বীকার বা নাকচ করার অবস্থায় নেতারা আছেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের দুই প্রধান দলই এখন এক নজিরবিহীন উভয় সংকট অবস্থা অতিক্রম করছে। অবশ্য সঙ্গত কারণেই এই উভয় সংকটের বিষয়টি বিরোধী দলে থাকার কারণে বিএনপির জন্য সব থেকে নাজুক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদিও এখন এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিএনপিকে বাদ দিয়ে ২০১৪ সালে নির্বাচন করেছিল, সেটা এবারেও তারা করতে চায় কি-না সেটি পরিষ্কার নয়। তাদেরও উভয় সংকট রয়েছে। বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করলেও সংকট, না নিয়ে করলেও সংকট। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির এমন লেজেগোবরে অবস্থা এভাবে আগে দেখা যায়নি।
এবারে বিষয়টি মোটেই এরকম নয় যে, ২০১৪ সালের আগে যেমনটা ছিল যে, নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে বিএনপিকে সুকৌশলে বাইরে রাখাই ছিল তাদের লক্ষ্য। পুরনো এই অভিযোগ ক্ষমতাসীন দল খুব জোরালোভাবে নাকচ করে দেয় না কিন্তু এবারে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ভিন্ন।

সরকারি মহল মনে করেন, কোনোভাবে বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করে যদি তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটা হবে অনেক বেশি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হবে। তারা সেই আশা বরবাদ করে দেননি। অবশ্য তারা মানেন যে, বিএনপির এই নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই কঠিন। অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, বিএনপি যদি এখন মনোনয়নপত্র দাখিল করেও, তদুপরি তারা নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করবেন না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এ প্রসঙ্গে তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের কথা বলেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ভোটের দিন বর্জন করে।
শক্তিশালী বৃটিশ সাময়িকী দি ইকোনোমিস্ট দুই দফা সংলাপ এবং তফসিল ঘোষণার প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচনী রাজনৈতিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে। তারা সরকারের এবং বিরোধী দলের ক্ষমতা এবং দুর্বলতা চিহ্নিত করলেও একটা বিষয় পরিষ্কার করতে পারেনি যে, যে নির্বাচনী অচলাবস্থা চলছে তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে কি না।
দি ইকোনোমিস্ট প্রশ্ন রেখেছে, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপসের বিষয়টি গণতন্ত্রকে স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় চলতে দিতে সুবিধা দেবে নাকি বর্তমান যে পরিস্থিতি রয়েছে, তাকে সামলাতেই প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগী থাকা সমীচীন হবে?

পত্রিকাটি বলেছে, ‘ভারত সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। এদিকে এখন কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপির কী লাভ হবে? তারা কি তাদের নেতার অবস্থান বজায় রাখতে পারবে? সেই প্রশ্নটিও কারো কারো মতে খুব পরিষ্কার নয়। কারণ, মনে করা হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। যদিও তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হবেন না কিন্তু যদি রিটার্নিং অফিসার তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেয় এবং তার বৈধতা তখন আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে এবং সিদ্ধান্ত আদালতের উপরে নির্ভর করবে। আর তখন সরকার বলতে পারবে যে এই বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেই। এটি স্বাধীন বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত। তাই দেখা যাচ্ছে নির্বাচনে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ তেমনি না যাওয়াও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
বিএনপি এখন স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়। কিন্তু কিছু সদস্য, যাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে, তারা বলেছেন, এ বিষয়টি স্পর্শকাতর, তাদের কারো পক্ষে হলফ করে বলা সম্ভব নয়।

ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৃত্তান্ত এবং দুই নেত্রীর পূর্ব বৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে গতকাল এই ইঙ্গিতই দিয়েছে যে, শেখ হাসিনার সৌজন্যমূলক কথোপকথন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড় দিতে কম উদারতার পরিচয় দিতে পারে।
পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ‘বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক কারাবন্দির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে ওই চিত্রগ্রাহক মানসিকভাবে অসুস্থ এবং তার পিতামহ পাকিস্তানপন্থি মন্ত্রী ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, কখনো কখনো রক্ত কথা বলে এটা আপনাকে বুঝতে হবে। এসব মন্তব্য যেন তার গ্রেপ্তারের কারণ হিসেবে এটাই হচ্ছে ব্যাখ্যা।

মাদকবিরোধী অভিযানে ২৬৪ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ছাত্রদের ওপর সরকারি বাহিনীর হামলার বিষয়টিও তারা উল্লেখ করেছে। ইকনোমিস্ট আবার একই সঙ্গে উল্লেখ করেছে যে আওয়ামী লীগকে দেশ পরিচালনায় নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে হবে- সেটারও কারণ নেই। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধির উদাহরণ তৈরি করেছে। গত বছর দেশটি ৭.৩ ভাগ জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার পেয়েছে। এটা গতিময়তার দিক থেকে ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। জনমত দেখাচ্ছে সরকার জনগণের বিরাট সন্তুষ্টি অর্জন করেছে।’ অনেকের ভয়, এসব কারণে বিএনপিকে তারা অগ্রাহ্য করতে পারে।

এদিকে বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সে বিষয়ে সেটাই শেষ কথা নয়। কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা অস্থায়ী চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
কিন্তু এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কী ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে ওই নেতা বলেছেন, এটা সাধারণভাবে বলা যায় যে বিএনপি নির্বাচনে যেতে আগ্রহী কিন্তু সেটা যদি কেবলই হারিয়ে দেয়ার একটি ঘটনায় রূপান্তরিত হয়, তাহলেও শুধুমাত্র বৈধতা দিতে বা নিতে তারা নির্বাচনে যাবে, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

উল্লেখ্য যে এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শুধু সরকারের বৈধতার প্রশ্ন মেটাতে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না।
নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেয়া হয় তার মধ্যে একটি হচ্ছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় অংশগ্রহণ করা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছিল বলে একটা কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে এবং বিএনপি এখনো পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও এ বিষয়ে দলের কোনো কোনো নেতা পক্ষে এবং বিপক্ষে মত দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন যে, নির্বাচনে এখনই যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে তা কৌশলগতভাবে ভুল হবে। কারণ, সামনে এখনো সময় রয়েছে।
এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না সেই সিদ্ধান্ত দেয়ার। কিন্তু নির্বাচনে না গেলে সে জন্য তার নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কায় তারা শঙ্কিত থাকবেন না। একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে কিংবা যদি ভিন্নরূপ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলেও ওই নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি তাদের বিবেচনায় থাকবে না। কারণ, তারা মনে করেন যে, যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়, তাহলে এই নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি বাধা হবে না। কারণ তারা মনে করে যে বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকে বাইরে রেখে একটি সরকার পরিচালনা বিশেষ করে একটি সংসদ পরিচালনা করা ১৬ কোটি জনগণের চোখে গ্রহণযোগ্য হবে না।

দি ইকোনোমিস্ট ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের সংলাপ সম্পর্কে লিখেছে, যদি এই সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে উদারনৈতিক অবস্থান জানানোর ব্যাপারে একটা ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল কিন্তু শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের চাহিদা পূরণ করেননি।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার কারা আদালত ত্যাগের আগে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে যে সিদ্ধান্ত দিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে সে কথার সত্যতা বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এখন পর্যন্ত স্বীকার করছেন না।

আশা করা হয়েছিল, পূর্ণ ধরপাকড় বন্ধ এবং অবাধে সমাবেশ করতে দেয়া হবে, কিন্তু গত সমাবেশের দিন কয়েক শ গ্রেপ্তার করা হয়। এই বিষয়টি তাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাহলে প্রাপ্তি কী। সরকার কী দেবে? সংসদে কতটি আসন বাস্তবে তারা পেতে পারে এবং এই আসন পাওয়ার ওপরই নির্ভর করছে যে তাদের শক্তি কতটা বৃদ্ধি পাবে। আর যদি দেখা যায় তারা সংসদে খুবই কমসংখ্যক আসন পেয়েছে, তাহলে তারা কী করবে? তখন তাদের পক্ষে সংসদে রাজপথে কোথাও তাদের শক্তি বা কার্যকর চাপ প্রদর্শন করা সম্ভব হবে না। কেউ কেউ বলছেন যে, তারা নির্বাচনে যেতে চান সেজন্য তারা অন্তত আশা করেছিলেন যে সরকার ধরপাকড় বন্ধ করবে, যেসব মামলা দায়ের আগে করা ছিল সেগুলোর না প্রত্যাহার করলেও তারা আর নতুন করে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করবে না। কিন্তু তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version