এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আদালতে বলেছেন, নির্বাচনের সঙ্গে সব কিছুর সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু এখানে (আদালতের ভেতরে) সবাই (আসামিপক্ষ) নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে সারা দিন আদালতে থাকলে নির্বাচন করব কিভাবে? তাহলে আমাদের বলে দেয়া হোক যে, আমাদের নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। তারা (সরকারি দল) মাঠে নির্বাচন করবে আর আমরা আদালতে থাকব- তা তো হতে পারে না।

তিনি বিচারকের উদ্দেশে আরও বলেন, এ মামলার বিচার এত দ্রুত শেষ করতে চাচ্ছেন কেন? অন্য মামলায় তো এরকম চেষ্টা দেখি না। কারাগারের ভেতরে বিচারের পরিবেশ নেই উল্লেখ করে তিনি আদালত আগের জায়গায় স্থান্তরেরও দাবি করেন।

বুধবার ঢাকার নয় নম্বর বিশেষ জজ আদালতে নাইকো দুর্নীতি মামলার শুনানিতে হাজির হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

শুনানি শেষে আদালতের বিচারক মাহমুদুল কবীর এ মামলার চার্জ (অভিযোগ) শুনানির জন্য ৩ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন।

ওই দিন এ মামলার অপর আসামি সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদের পক্ষে চার্জ শুনানি শেষ করার নির্দেশনা দেন আদালত।

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মামলায় জড়িত মওদুদ আহমদ নির্বাচনী কাজে এলাকায় ব্যস্ত থাকবেন উল্লেখ করে বিচারকের কাছে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য না করে জানুয়ারির যে কোনো দিন ধার্য করার নিবেদন করেন। পরে বিচারক বাস্তবতা বিবেচনা করে শুনানি ৩ জানুয়ারি রাখেন।

এদিন বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটের দিকে কারাগারের ভেতর থেকে খালেদা জিয়াকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর স্থাপিত আদালতে হাজির করা হয়।

আদালতের কার্যক্রম শেষে তাকে ফের কারাগারে নেয়া হয়। আদালতে তিনি হুইল চেয়ারে বসা ছিলেন। এ সময় তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কারাগারে তার সঙ্গে থাকা কাজের মেয়ে ফাতেমা।

খালেদা জিয়া আদালতে আসার পরপরই আদালতের পরিবেশ ও অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেন, পুলিশকে এভাবে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কেন? এত বেশি সিকিউরিটির কি হয়েছে এ কোর্টে?

খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত হওয়ার ২ মিনিট পরই বিচারক এজলাসে আসেন।

শুরুতেই খালেদা জিয়ার আইনজীবী মো. মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতের উদ্দেশে বলেন, এ আদালতে বসার জায়গা নেই। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ আরেকটু সরে দাঁড়ালে মুক্ত পরিবেশ পাই।

এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, জায়গাটা আরেকটু বড় করুন। আর পুলিশকে আরেকটু সরে দাঁড়াতে বলুন। এ সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ভবিষ্যতে আমরা আরও খোলামেলা জায়গার ব্যবস্থা করব।

শুনানিতে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতা ও নাইকো মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বিচার চলার জন্য এ আদালতে কোনো পরিবেশ নেই। কোনো বিবেকবান মানুষ বলতে পারবেন না যে- এটা বিচারের জায়গা। আপনি (বিচারক) কি কোনো দিনও এত ছোট্ট জায়গায় বিচার করেছেন? আইন অনুযায়ী যা খুশি করেন। তবে আইন অনুসারে আমাদের অধিকার বঞ্চিত করবেন না। সংবিধান অনুযায়ী এটা ‘পাবলিক ট্রায়াল’ হতে পারে না। এর আগেও হাই সিকিউরিটির একটা মামলার বিচার হয়েছে এমন আদালতে। তবে এ মামলা হাই সিকিউরিটি মামলা নয়। আমাকে আপনি (বিচারক) সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা দিতে পারবেন। আমাদের দেশে আইনের শাসন বিলুপ্তির পথে।

এরপর খালেদা জিয়া বলেন, দেশে ক’টা মামলা দ্রুত বিচারে সম্পন্ন হয়েছে। সেভেন মার্ডারও তো দ্রুত বিচারে হয়নি। তাহলে আমাদের মামলাগুলো দ্রুত বিচারে কেন? এ আদালতের পরিবেশ নেই। এর চেয়ে বকশীবাজার আদালত ভালো ছিল।

বিচারক বলেন, প্রজ্ঞাপন দিয়ে আদালত এখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। আদালতের পরিবেশ ও পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি প্রসিকিউশনকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাতে আদেশ দেন।

মওদুদ আহমদ বলেন, আমি একটি দলের নেতা। আমাকে ৪০০ লোককে পরীক্ষা করতে হবে। কিছুক্ষণ পর আমাকে নির্বাচন কমিশনে যেতে হবে। আমাদের নেত্রীকে জেলে রেখে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। আমরা নির্বাচনে গিয়ে বিরাট জাতীয় সমস্যার সমাধান করেছি। আমরা নির্বাচনে না গেলে ২০১৪ সালের মতো অবস্থা হতো। দলীয় নেতাকর্মীরা নেত্রীকে জেলে রেখে নির্বাচনে যেতে চান না। তবুও নেত্রীর আদেশে আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি। আর শারীরিকভাবে আমি অসুস্থ। ৩০ ডিসেম্বরের পর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে সময় দেয়া হোক। এর বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় ২ বছর ধরে খালেদা জিয়া ও মওদুদ আহমদের শুনানির জন্য অপেক্ষা করা হয়েছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

এরপর খালেদা জিয়া আদালতের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে সব কিছুর সম্পর্ক রয়েছে। এখানে (আদালতের ভেতর) সবাই (আসামিপক্ষ) নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যেকে প্রার্থী না হলেও তারা সবাই নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত। এভাবে যদি সারা দিন আদালতে আমাদের ধরে রাখেন তাহলে নির্বাচন করব কিভাবে? তারা (সরকারি দল) মাঠে নির্বাচন করবে আর আমরা আদালতে থাকব- তা তো হতে পারে না।

এরপর বিচারক মওদুদ আহমদকে চার্জ শুনানি শুরু করার আদেশ দেন। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে মওদুদ চার্জশিটের কিছু অংশ পাঠ শুরু করেন।

শুনানির একপর্যায়ে তিনি বলেন, সরকারের প্রয়োজনে টেন্ডার ছাড়াও কেনাকাটা করা যেতে পারে। যেমন ইভিএম কেনা হয়েছে। একটা ইভিএমের দাম ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যেখানে ভারতে এর দাম ২০ হাজার টাকা। সরকার মনে করে, এটা তাদের দরকার। জাতীয় প্রয়োজনে তাদের জয় লাভের জন্য প্রয়োজন। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মওদুদ আহমদ আদালতের কাছে শুনানি মুলতবি রাখার জন্য সময়ের আবেদন করেন। এ সময় তীব্র বিরোধিতা করেন দুদকের আইনজীবী।

তিনি বলেন, এভাবে করলে মামলা এগোবে না। মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচকালীন সময়ে সবাই সবাইকে সহায়তা করবে- এটাই নিয়ম। তাহলে সব কিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।

এ পর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, সবাই ব্যস্ত থাকবেন। এটা আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। সবাই নির্বাচনে নিজ নিজ এলাকায় যাচ্ছেন। আর আমারও আসাটা কষ্টকর হবে। নির্বাচনের পর দিন ধার্য করুন।

এ পর্যায়ে দুদকের পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল এর বিরোধিতা করলে খালেদা জিয়া তার উদ্দেশে বলেন, আপনাকে তো আওয়ামী লীগের মন্ত্রী বানিয়ে দেয়া উচিত।

এ সময় কাজল বলেন, ম্যাডাম আপনি দোয়া করবেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদারও আদালতে পিপির উদ্দেশে বলেন, আপনি আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন। আমরা চাই আপনি প্রসিকিউটর হিসেবে প্রতিমন্ত্রী হন। কারণ আপনার আগেও একজন প্রসিকিউটর (আনিসুল হক) মন্ত্রী হয়েছেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক ৩ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।

আদালতের কার্যক্রম শেষে আদালতের অনুমতি নিয়ে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আহমেদ আজম খান, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার খালেদা জিয়ার সঙ্গে কিছু সময় একান্তে কথা বলেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে চিকিৎসার জন্য তাকে ৬ অক্টোবর বিএসএমএমইউতে নেয়া হয়। তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির অপর মামলায়ও সাজাপ্রাপ্ত হন। সেখান থেকে ৮ নভেম্বর তাকে সরাসরি আদালতে হাজির করা হয়। চিকিৎসা শেষে বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কানাডার কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে অস্বচ্ছ চুক্তি করে রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।

২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) মুুহাম্মদ মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেন।

তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ৫ মে দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) এসএম সাহিদুর রহমান এ মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন।

চার্জশিটে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের পক্ষে আংশিক চার্জ শুনানি হয়।

খালেদা জিয়া ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেন, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সিএম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ। এদের মধ্যে বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান মারা গেছেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version