এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। বুধবার দুপুরে ১ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এ সংঘর্ষে গোটা এলাকা যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এ সময় নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরাও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সংঘর্ষে পুলিশ, বিএনপি নেতাকর্মী ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। যখন সংঘর্ষ শুরু হয়, তখন বিএনপি কার্যালয়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমার কার্যক্রম চলছিল।

সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি এবং পুলিশ পরস্পরকে দায়ী করেছে। বিএনপি বলেছে, ‘সরকারের নির্দেশে’ পুলিশ বিনা উসকানিতে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর ‘হামলা’ চালিয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ বলেছে, নির্বাচন সামনে রেখে ‘ইস্যু তৈরির লক্ষ্যে’ বিনা উসকানিতে বিএনপি কর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

সংঘর্ষের সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভয়ে পথচারীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন। রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

একপর্যায়ে নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে বলে বুধবার রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া।

তিনি বলেন, এসব মামলায় ইতিমধ্যে ৪০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৩০ জনের মতো ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এবং ক্রাইম ডিভিশন।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, নৈরাজ্য করে কেউ পার পাবে না। অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’

এদেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সকাল থেকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভিড় ছিল। এ ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল পুলিশ।

বেলা পৌনে ১টার দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মিছিল নিয়ে ঢাকা-৮ আসনের জন্য মনোনয়ন ফরম কিনতে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আসেন।

এ সময় বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আরও কয়েকটি মিছিল দলীয় কার্যালয়ের সামনে এসে জড়ো হয়। তখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে কার্যালয়ের সামনে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন এবং তাদের ফুটপাতের দিকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

এ সময় পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। পুলিশ কয়েকজন নেতাকর্মী ও সমর্থককে লাঠিপেটা করে। এতে উপস্থিত নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

ক্ষুব্ধ বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের ওপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে প্রথমে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও ছররা গুলি ছোড়ে।

এতে বিএনপির ১৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে বিভিন্ন হাসপাতালে নিতে দেখা গেছে। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন।

ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের হামলায় পুলিশেরও ১৩ সদস্য আহত হন।

এ সময় মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনারের পিকআপ ভ্যানসহ পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন তারা। পাশাপাশি পুলিশের সাঁজোয়া যানে হামলা চালান নেতাকর্মীরা।

দুপুর দেড়টার দিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে দেয়া আগুন নেভাতে কাজ শুরু করেন। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রাস্তায় পথচারীদের কয়েকটি গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের গ্লাস ভাংচুর করেন।

তখন এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের কারণে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পল্টন, কাকরাইল, ফকিরাপুলসহ আশপাশ এলাকায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ঘটনাস্থলে পুলিশের জলকামান ও সাঁজোয়া যান মোতায়েন করা হয়।

সংঘর্ষ চলাকালে প্রায় ২ ঘণ্টা বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি বন্ধ ছিল। ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের হামলায় মতিঝিলের এডিসি শিবলী নোমান, সিনিয়র সহকারী কমিশনার মিশু বিশ্বাস, সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) ইলিয়াস হোসেনসহ ১৩ জন আহত হন।

আহতরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের দিকে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সংঘর্ষে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন তারা হলেন- পিরোজপুরের নেছারাবাদের শামসুল হক, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্যজীবী দলের সভাপতি সালাহ উদ্দিন লিটন, রাজধানীর মুগদার মেহেদি হাসান মিরাজ, অরিন, পল্টনের কাদির, হৃদয় শেখ, মতিঝিলের মকবুল হোসেন, সবুজবাগের মনির হোসেন, খিলগাঁওয়ের মোস্তাক, কলাবাগানের সুমন, বিমানবন্দর থানা এলাকার মহিউদ্দিন রতন, মাদারীপুরের সাখাওয়াত হোসেন এবং পিরোজপুরের আসাদুজ্জামান। তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলির আঘাত লেগেছে।

হামলার ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন বানচালের জন্য নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা ও গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি এটা পরিকল্পিতভাবে হামলা হয়েছে। যখন দেশ একটি সুন্দর নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন যখন সিডিউল ঘোষণা করেছে, মানুষ যখন একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে, সেই সময়ে এটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে।’

এছাড়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন বানচালের জন্য বিএনপি পরিকল্পিতভাবে নয়াপল্টনে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি সম্পূর্ণ বিনা উসকানিতে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, সংঘর্ষের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে দলটির মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এ ধরনের পরিস্থিতি করে সরকার নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করছে। ভোটের অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আহ্বান জানাই।

আর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর গাত্রদাহ থেকেই এ হামলা চালানো হয়েছে। নয়াপল্টনে এত নেতাকর্মী কেন তা উনি সহ্য করতে পারছেন না।

মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, বিনা উসকানিতে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলা চালায়।

তিনি বলেন, পুলিশ শুধু তাদের রাস্তা থেকে সরে যেতে বলেছিল, যেন যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু তারা সে কথা না শুনে হঠাৎ পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পরে তারা আমাদের দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। আমাদের কয়েকজন সদস্যও আহত হন। পুলিশ ধৈর্য-সহকারে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। এ ঘটনায় কাউকে এখন পর্যন্ত আটক করা হয়নি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।’

‘ইস্যু’ তৈরির লক্ষ্যে পল্টনের সংঘর্ষ -মনিরুল : বিএনপি কর্মীরা নির্বাচন সামনে রেখে ‘ইস্যু তৈরির লক্ষ্যে’ বিনা উসকানিতে নয়াপল্টনে সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, এ ঘটনায় মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের এডিসিসহ ১৩ পুলিশ সদস্য আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পুলিশের এ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘বিনা উসকানিতে ইস্যু তৈরি করার জন্য এটা করেছে ওরা। পুলিশ অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে।’

নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা তা মানেনি। উল্টো পুলিশের ওপর ঢিল ছুড়তে শুরু করে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘দুজন রাজনৈতিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় হাজার হাজার নেতাকর্মী পার্টি অফিসের সামনে আসে। এ সময় রাস্তা বন্ধ হয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।’

সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশের দুটি সেডান গাড়ি ও একটি ভ্যানে বিএনপি কর্মীরা হামলা করে এবং পরে দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে জানান তিনি। বিএনপি নেতাকর্মীদের সুশৃঙ্খলভাবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার অনুরোধ জানিয়ে মনিরুল বলেন, ‘পুলিশ রাষ্ট্রের কর্মচারী। পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাববেন না।’

থমথমে নয়াপল্টন : দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের মধ্যেই ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর ওই এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সকালে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিতি থাকলেও সংঘর্ষের পর নেতাকর্মীরা নয়াপল্টন ছেড়ে গেছেন। দলীয় কার্যালয়ের সামনে তেমন উপস্থিতি নেই নেতাকর্মীদের। অন্যদিনের মতো দলীয় কার্যালয়ের সামনে নেই পুলিশ।

তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে নাইটিঙ্গেল মোড় ও ফকিরাপুলে। এ ঘটনার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক শুরু হয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version