এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তার বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ওয়াদা নেন।
তিনি বলেন, কারও মুখ দেখে নয়, জরিপ রিপোর্ট দেখেই দলের মনোনয়ন দেয়া হবে। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। আগামী নির্বাচন খুব কঠিন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। এ সময় সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিজের ওপর আসা বিভিন্ন আঘাত, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও আগামীতে ক্ষমতায় না আসতে পারলে দেশ অতীতের মতো ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাবে বলেও উপস্থিত নেতাদের মনে করিয়ে দেন তিনি।
বুধবার দুপুরে গণভবনে আওয়ামী লীগের ৪ হাজার ২৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন।
দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যের এক পর্যায়ে ১৫ আগস্টে স্বজন হারানোর প্রেক্ষাপটসহ নিজের ওপর আসা বিভিন্ন হামলা-মামলা ও আঘাতের কথা তুলে ধরে আবেগঘন বক্তব্য দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আবেগঘন বক্তব্যে স্তব্ধ হয়ে যান উপস্থিত নেতারা।
এর আগে সকাল থেকে গণভবনে আসতে শুরু করেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। শুরুতেই নির্বাচনে দলীয় প্রস্তুতি ও অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তার বক্তব্যেও ছিল কঠোর সাংগঠনিক নির্দেশনা। গণভবনে উপস্থিত একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে কে বড় নেতা, কে ছোট নেতা এই বিষয়টি গুরুত্ব পাবে না। বিভিন্ন জরিপে যারা এগিয়ে আছে, তাদেরই নৌকার মনোনয়ন দেয়া হবে। যাকে মনোনয়ন দেব তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তাকেই আপনাদের মেনে নিতে হবে। মনোনীত প্রার্থীর জয় নিশ্চিতের দায়িত্বও আপনাদের। আপনারা কথা দিলেন? এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কথায় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সবাই দুই হাত উঁচু করে সম্মতি দেন।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় আসছি মনে করে নিজেদের মধ্যে খাওয়া-খাওয়ির মনোভাব, তা পরিহার করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দলের যারা ইতিমধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হবে না। বর্তমান সংসদের এমপিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত দুই দফায় নির্বাচনে এনেছি, এবারও আমিই ক্ষমতায় আনব- এটা মনে করে কোনো লাভ নেই। প্রার্থীর নিজ নিজ যোগ্যতা, দক্ষতা, রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা থাকতে হবে। অবশ্যই তাকে জনসম্পৃক্ত হতে হবে। আমি সবার সম্পর্কে জানি। আপনাদের সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। কারা কি করেছেন, কারা কোন দল থেকে এসেছেন। বেশি লাফালাফি করার দরকার নেই। কোনো গ্রুপিংয়ের দরকার নেই।
এবার আশাতীত মনোনয়ন ফরম বিক্রির প্রসঙ্গ তুলে কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
তিনি বলেন, এবার ৩শ’ আসনে চার হাজার ২৩ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এটা একদিকে ভালো। তবে কিছু কিছু আসনে অস্বাভাবিক হারে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে ওই এলাকায় দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে। সেখানে নেতৃত্বশূন্যতা রয়েছে। ওইসব স্থানে যত বড় নেতাই থাকুক, তারা পার্টিকে অর্গানাইজড করতে পারেনি। এটা তাদের নেতৃত্বশূন্যতার প্রমাণ। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আগামীতে ক্ষমতায় এলে এগুলোরও সমাধান করা হবে।
জরিপ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতীয়ভাবে জরিপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ভাড়া করে জরিপ চালিয়েছি। প্রতিটি এলাকায় মাঠে-ঘাটে সাধারণ মানুষের কাছে বর্তমান এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে মতামত নেয়া হয়েছে। চা দোকানদার, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, রিকশাওয়ালার কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। এমপি ভালো না মন্দ। কার কি অবস্থান? এসব বিষয়ে বারবার খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। এই জরিপে যারা এগিয়ে আছেন। তাদেরই মনোনয়ন দেয়া হবে। কোন প্রার্থীর প্রতি ভোটারের সমর্থন আছে, সেটা বিবেচনায় নেয়া হবে। একটি কথা আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, দল থেকে মনোনয়ন যাকেই দেয়া হবে, তার পক্ষেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করা হলে আজীবনের জন্য তাকে বহিষ্কার করা হবে। একটা সিটে না জিতলে কি হবে? কারও এমন মনোভাব পোষণ করা যাবে না। এই মনোভাব দূর করতে হবে। বিজয়ী হতে হলে প্রতিটি আসনকেই গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো আসনেই হারব না এই মানসিকতা সবাইকে পোষণ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ও নিজ পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপনের প্রসঙ্গ তুলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থন আছে, কর্মী আছে, ভোট আছে কিন্তু ইদানীং দৃশ্যমান কর্মী নেই। ১৯৮১ সালে নেতৃত্বে এসে আমি দলকে সংগঠিত করেছি। এর আগে জিয়াউর রহমান ৬ বছর আমাকে দেশে আসতে দেয়নি। দেশে ফিরলেও ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমার বাবা-মায়ের জন্য মিলাদ ও দোয়া পড়তে দেয়া হয়নি। বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। রেহানার পাসপোর্ট ইস্যু করতে দেয়া হয়নি। বিদেশে ফেরারী জীবনযাপন করতে হয়েছে আমাদের। দেশে ফিরে তিলে তিলে এই দলকে গড়ে তুলেছি। আমি, রেহানা, জয়, পুতুলসহ আমার পরিবারের সদস্যরা অসহায় সময় পার করেছি।
তিনি বলেন, অতীতে আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু কেউ এ দলকে দমাতে পারেনি। এখনও নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে।
নির্বাচন আর পেছানো হবে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে। আমরা মেনে নিলাম। সেই অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু হঠাৎ বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন ১ মাস পেছানোর দাবি জানানো হল। কমিশন সবকিছু হিসাব করে ১ সপ্তাহ পেছাল। আমরা কোনো প্রতিবাদ করিনি। এখন আবার তারা ভোট পেছানোর দাবি তুলেছে। এটা কেন? কি কারণে নির্বাচন পেছাতে হবে? তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এরপর একদিনও নির্বাচন পেছানো হবে না। যদি তা করা হয় আওয়ামী লীগ সেটা মানবে না।
প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ছিল স্বর্ণযুগ। ২০০১ সালে দেশের সম্পদ গ্যাস রফতানি করার মুচলেকা না দেয়ায় আমরা ক্ষমতায় আসতে পারিনি। বিএনপি মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। এরপর বিএনপির ৫ বছর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর বহু জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে। বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পারলে দেশ অনেক পিছিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর আরও জুলুম-নির্যাতন নেমে আসবে। তাই এসবের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে।