এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : কাশ্মীর-পৃথিবীর বুকে ‘আরেক ফিলিস্তিন’। ভারত নিয়ন্ত্রিত এ ভূস্বর্গের নিঃশ্বাসে এখন লাশের গন্ধ। শোক-কান্না-বিক্ষোভ এখানকার প্রতিদিনের চিত্র।
ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটে মানুষের। শিশুদের আঁকা ছবিতে ফুটে ওঠে না শুভ্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উঠে আসে লাল টগবগে রক্ত, বন্দুক-বুলেটের চিত্র। হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিশু-তরুণ-যুবক। বিছানায় কাতরাচ্ছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
ভারতের সামরিক বাহিনীর ছোড়া গুলিতে তাদের চোখ গেছে! কয়েক প্রজন্ম ধরেই কাশ্মীরে বিক্ষোভ দমনের এসব চিত্র দেখে আসছে বিশ্ব। কাগজে-কলমে বা মুখে না বললেও ফিলিস্তিনে মধ্যপ্রাচ্যের ‘দানব’ ইসরাইলের সুদূরপ্রসারী ‘খোঁড়া প্রজন্মের’ মতোই কাশ্মীরে ‘অন্ধ প্রজন্ম’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত। গত কয়েক বছরে উঠতি বয়সী কাশ্মীরিদের চোখ হারানোর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দেশটির সে উদ্দেশ্যই স্পষ্ট করে তুলছে। চলতি বছরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছোড়া ছররার আঘাতে শতাধিক কাশ্মীরি অন্ধ হয়েছেন।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীর সমস্যার শুরু। ১ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এ অঞ্চলটিতে ৭০ শতাংশ মুসলমানের বাস। কাশ্মীরের জনগণের একটি বড় অংশ স্বাধীনতা চায়। অথচ ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করে রেখেছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ওই এলাকায় স্বাধীনতার পক্ষে ভোটাভুটি করার প্রস্তাব দিলেও তাতে ভারত সায় দেয়নি। আর কাশ্মীর স্বাধীনতার প্রশ্নে তরুণ-যুবকরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৮৯ সাল থেকে মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করে ভারত। প্রতিদিনই দু-চারজন যুবক হত্যার শিকার হচ্ছেন।
স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ রুখতে ২০১০ সাল থেকে পেলেট গান (ছররা গুলি) নামক এক ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে নিরাপত্তা বাহিনী। শুধু কাশ্মীরেই এই পেলেট গান ব্যবহার করে ভারত। বন্দুকের গুলির মতো মারণাস্ত্র নয় এ ছররা। একেকটি শেলের মধ্যে ছোট ছোট পাঁচ শতাধিক লোহার বল থাকে। বন্দুক থেকে এই শেল ছোড়া হলে বাইরের খোলস ফেটে লোহার দানাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। চোখে লাগলে হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ছররা গুলির ব্যবহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
চলতি বছরে ভারতীয় বাহিনীর হামলায় অন্তত ৪১৩ জন নিহত হয়েছেন। গুলিতে বহু কাশ্মীরি শিশু-তরুণ-যুবক চোখ হারিয়েছেন। কাশ্মীর সরকারের এক তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে আট শতাধিক কাশ্মীরি চোখে আহত হয়েছিলেন। তবে পেলেট ভিকটিম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মতে, ২০১৭ সালে ১২০০-এর বেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর চোখে ছররার গুলি লেগেছে।
এর মধ্যে শতাধিক কাশ্মীরির এক বা উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালকে তো ‘গণ-অন্ধত্ব সাল’ বলা হয়ে থাকে। ওই বছরের ৮ জুলাই ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতা বুরহান ওয়ানির হত্যায় উত্তপ্ত কাশ্মীরে ১১০০ জনের চোখে ছররা ঢোকে।
২৫ নভেম্বর ডান চোখে ছররার গুলি ঢোকে ২০ মাস বয়সী হিবা জানের। বাইরে সংঘর্ষ চলছিল। ঘরেই বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে থেকেও রক্ষা পায়নি সে। ভারতের সেনাবাহিনীর ছোড়া কাঁদানের গ্যাসের ঝাঁজে দরজা খুলতে বাধ্য হয় হিবার বাবা নিসার আহমেদ।
হঠাৎই খোলা দরজা দিয়েই ভেতরে ঢুকে তার চোখে লাগে ছররা। হিবার চোখের আলো রক্ষার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ২৮ নভেম্বর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা জাভেদ জাত নিহত হওয়ার ঘটনায় বিক্ষোভে গুলিবিদ্ধ হয় শাহিদ আহমেদ (১৬)।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছোড়া পেলেট গান তার বাম চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। একই দিন ছররা গুলিবিদ্ধ হয় ওয়ায়েব আহমেদ (১৪) ও ফায়েজ আহমেদ (২৮)। চোখের আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ ফায়েজের।
২৮ নভেম্বরের বিক্ষোভে বাঁ চোখে গুলিবিদ্ধ ফায়াজ আহমেদ (২৮) শ্রীনগরের হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ছররা গুলিতে উভয় চোখ হারান ইনশা মুশতাক (১৪)। সংঘাত শুরুর হইচইয়ের মধ্যে জানালার পাশে দাঁড়ালে তার চোখে আঘাত হানে গুলি। ওই বছরই গুলিবিদ্ধ হয়ে চোখ হারান দানিস রজব (২৪) ও ফেরদৌস আহমেদ দার (২৫)।
চলতি বছরের মার্চে মাঠে খেলা করার সময় মাথায় ও চোখে ছররায় বিদ্ধ হন আসিফ দার (২১)। বর্তমানে তিনি অন্ধ। কাশ্মীরিদের দুঃখের ইতিহাস বিগত সাত দশক ধরে চলছে। আর অন্ধ এসব কাশ্মীরি তরুণের হাহাকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য বর্বতাকে তুলে ধরেছে বিশ্বের কাছে। ফিলিস্তিনিদের হাতে-পায়ে গুলি করে ইসরাইল যেভাবে পঙ্গু করা হচ্ছে ঠিক সেভাবেই কাশ্মীরিদের অন্ধ করে দিচ্ছে ভারত।