এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মনোনয়ন বাছাইয়ে রিটার্নিং অফিসারের দেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন পড়েছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। গত তিন দিনে মোট ৫৪৩টি আপিল আবেদন গ্রহণ করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল বুধবার আবেদন গ্রহণের শেষ দিনে আপিল জমা পড়ে মোট ২২৪টি। এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় দিন যথাক্রমে ৮৪ ও ২৩৫টি আপিল আবেদন জমা পড়ে। মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রার্থিতা ফিরে পেতে ও মনোনয়নের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এসব আপিল করেন সংক্ষুব্ধ প্রার্থীরা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধেও আপিল হয়েছে গতকাল। আজ বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত তিন দিনে শুনানি করে এসব আপিল নিষ্পত্তি করবে কমিশন। তবে আপিলের নিষ্পত্তি দুই দিনে শেষ করার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

বুধবার সন্ধ্যায় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, বিপুল সংখ্যক আবেদন থাকায় তিন দিনেই আপিল শুনানি হবে।

আপিল আবেদন নাকচ হয়ে গেলে কমিশনের সিদ্ধান্তের নকল কপি প্রার্থীকে কমিশন থেকে দিয়ে দেয়া হবে। রেকর্ড সংখ্যক প্রার্র্থীর আপিল আবেদন নিষ্পত্তি নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়েছে কমিশন। আগামী রোববার মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। আপিলে যারা বৈধ হবেন তাদের প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে সোমবার। যেসব দলের একই আসনে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন তাদের রোববারের মধ্যেই রিটার্নিং অফিসারের কাছে চূড়ান্ত দলীয় মনোনয়নের চিঠি জমা করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রাজনৈতিক দলগুলোও। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা বিভাগে ২৫, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০, সিলেট বিভাগে ১৮, বরিশাল বিভাগে ১৮, ঢাকায় অন্তত ৪৮, চট্টগ্রামে অন্তত ৪৮, রাজশাহীতে ৩২ ও রংপুর বিভাগে মোট ২১টি আপিল আবেদন জমা পড়েছে। তবে প্রথম দুই দিনের তুলনায় শেষ দিনে মনোনয়নের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল আবেদন জমা পড়েছে বেশি। বিকাল ৫টা পর্যন্ত আপিল আবেদন গ্রহণ করার কথা থাকলেও শেষ সময়ের বিবেচনায় ৫টার পরও বেশ কয়েকজন প্রার্থীর আপিল আবেদন গ্রহণ করে কমিশন।

ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ৭৮৬টি বাতিল মনোনয়নপত্রের মধ্যে ৩৮৪টি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই ১% স্বাক্ষর গরমিলের কারণে বাদ পড়েছে; যাদের প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের মিলিয়ে অন্তত ১৩০ জন রয়েছে। বাকিদের মধ্যে দলীয় প্রত্যয়ন না থাকা, হলফনামা মিথ্যা তথ্য দেয়াসহ হরেক রকমের আইনি ব্যত্যয় রয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনদিনে যুক্তিযুক্ত আবেদনকারীদের শুনানিতে পর্যাপ্ত সময় মিলবে বলে মনে করেন ইসি কর্মকর্তারা। কমিশন সূত্রে জানা যায়, আপিল আবেদনের শেষ দিনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অন্তত ২০জন প্রার্থী আপিল করেন।

সকালে, ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী মির্জা আব্বাসের প্রার্থিতার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মহাজোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেননের পক্ষে আপিল করেন তার আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম। বরিশাল-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পঙ্কজ দেবনাথের মনোনয়নের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আপিল আবেদন করেন ওই আসনের দুই প্রার্থী। বরিশাল-৪ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মেজবাহউদ্দিন ফরহাদ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মাহাবুবুল আলম মাস্টার্স পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে আপিল করেন। মামলা জটিলতা বিষয়ে উল্লেখ করেন এই দুই প্রার্থী। এ ছাড়া, রংপুর-৩ আসনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও দলের প্রার্থী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে আপিল করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের প্রার্থী সাব্বির আহমেদ। বিদেশে ব্যবসার তথ্য গোপন, কর ফাঁকি, মামলার তথ্য গোপনসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে এরশাদের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। এছাড়া বগুড়া-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী আব্দুল মমিনের বিরুদ্ধে আপিল করে মুক্তিযোদ্ধা সারওয়ার হোসেন।

সকালে তিনটি আসনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বৈধতা চেয়ে নির্বাচনে কমিশনে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। বগুড়া-৭ আসনে মাসুদ আহমেদ তালুকদার, বগুড়া-৬ আসনে নওশাদ জমির ও ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার পক্ষে আপিল আবেদন জমা দেন কায়সার কামাল। এ সময় কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষ থাকলে নির্বাচনে লড়তে পারবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। উচ্চ আদালতের আপিলের বিষয়ে আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশন খালেদার প্রার্থিতা ফিরিয়ে দিয়ে ন্যায়বিচার করবে বলেও প্রত্যাশা করেন তারা।

এদিকে, বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ৩ থেকে ৫ই ডিসেম্বর সংক্ষুব্ধ প্রার্থীরা ৫৪৩টি আপিল আবেদন জমা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন ভবনের ১১তলায় এজলাস কক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের উপস্থিতিতে এসব আপিলের নিষ্পত্তি হবে। তিন দিনের মধ্যেই নিষ্পত্তি সম্ভব বলেও এ সময় জানান নির্বাচন কমিশন সচিব। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হবে আপিল আবেদনের শুনানি। প্রথম দিন ১-১৬০ ক্রমিক নম্বরের আপিল আবেদন শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

আগামীকাল শুক্রবার ১৬১-৩১০ ক্রমিক নম্বর ও ৮ ডিসেম্বর শনিবার ৩১১ নম্বর অবশিষ্ট আপিল আবেদন শুনানি নিষ্পত্তি করা হবে। সকাল দশটায় শুরু হয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে আপিল আবেদন। মধ্যাহ্ন বিরতি দিয়ে যতক্ষণ প্রয়োজন হয় সে সময় পর্যন্ত আপিল শুনানি করা হবে। তাৎক্ষণিকভাবে আপিল নিষ্পত্তি শেষে জানিয়ে দেয়া হবে ফল। এদিকে, ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি শেষ করতে বিএনপির অনুরোধের বিষয়টি বিবেচনা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েন ইসি সচিব। তিনি বলেন, ‘অনেক সংখ্যক আপিল কারণে এটি সম্ভব নয়। তাদেরকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।’ ইসি সচিব আরো বলেন, তাৎক্ষণিক ভাবে রায়, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে লম্বা সময় প্রয়োজন।

আপিল আবেদন নাকচ হয়ে গেলে কমিশনের সিদ্ধান্তের নকল কপি প্রার্থীকে কমিশন থেকে দিয়ে দেয়া হবে। জানান, রাজনৈতিক দল হিসেবে আপিলের সংখ্যা গণনা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়ায়, অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে ভোট করতে কমিশনের কোনো আইনি বাধা নেই বলেও জানান ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। বিভিন্ন আসনে রাজনৈতিক দলগুলোর একাধিক প্রার্থী সম্বন্ধে ইসি সচিব বলেন, চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য রিটার্র্নিং কর্মকর্তার কাছে যেটি পাঠানো হবে তাই গ্রহণ করা হবে। এছাড়া, আপিল শুনানির পর তড়িৎ গতিতে এমনকি প্রয়োজনে টেলিফোনে মনোনয়ন বৈধতার বিষয়ে স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়ে দেয়া হবে। ইসি সচিব বলেন, প্রার্থী বা যে কোনো ব্যক্তি আগামী ৯ই ডিসেম্বর তার পক্ষে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে পারবেন। দলীয় অফিস থেকে চিঠি দিয়ে জানালে বাকি প্রার্থীরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাতিল হয়ে যাবেন।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, যেসব আসনে একাধিক প্রার্থী আছে, একজনকে চূড়ান্ত করে চিঠি দিলেই বাকি প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নের অযোগ্য বিবেচিত হবেন। অনলাইনে, মেইলে, ওয়েবসাইটে পাঠিয়ে দিলেই হবে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও নতুন দায়িত্ব পাওয় মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙার স্বাক্ষরিত চিঠি পেয়েছে কমিশন। সে কারণে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বদলে তাদের প্রার্থিতায় কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version