এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : এটাও ভোটের নতুন মডেল। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক জমানায় এমন ভোট আর আসে নি। যদিও ভোটের বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে এ ভূমের মানুষের। বলা হয়ে থাকে, ভোট পবিত্র আমানত। অধিকার। কিন্তু ইতিহাসে দেখা গেছে বহুবারই মানুষ স্বাধীনভাবে সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের নেপথ্যে ব্যালটের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ’৭০-এর নির্বাচনে এ দেশের জনগণ।

নিরঙ্কুশভাবে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে বেশিরভাগ নির্বাচনই নানা বিতর্ক তৈরি করে। ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ভোটের মতো কলঙ্কিত অধ্যায়ও রয়েছে। তবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সবক’টি নির্বাচনই মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন ছিল একতরফা এবং বিতর্কিত।

এবারই প্রথম দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে চলছে। তফসিল ঘোষণা, মনোনয়ন যাচাই-বাছাই এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা ভোটের মাঠে ইতিবাচক ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত তেমন বেশি কিছু পাননি। নির্বাচনের পর সবকিছু কমিশনের অধীনে চলে যাবে সে বক্তব্য কেতাবেই রয়ে গেছে। তফসিল ঘোষণার আগে-পরে মাঠে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে নি।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দায়ের হওয়া গায়েবি মামলা এখন পুরোদমে কাজ করছে। বিরোধী নেতাকর্মীরা রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন খুব কমই। বেশ কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী কারাগারে রয়েছেন। বিএনপির এক নেতা দাবি করেছেন, এ সংখ্যা ২৭। বিএনপির ১৪১ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জেনুইন কারণের পাশাপাশি ছোটখাটো ত্রুটির কারণেও মনোনয়ন বাতিল হয়েছে অনেকের।

কেমন হবে নতুন ধারার এই ভোট? আলামত এরই মধ্যে কিছুটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ভোটের বাকি মাত্র ২৪ দিন। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ঘিরে যেমন উৎসব আর লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি হয় তা এখনো হয়নি। মাঠ এক পক্ষের দখলে। আরেক পক্ষ রয়েছে নানা ভয়ভীতিতে। গ্রামে-গঞ্জে ভোটের হাওয়া তেমন তৈরি হয়নি। বিশ্লেষকরাও এখনো হলফ করে বলতে পারছেন না কেমন হবে নির্বাচন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, মনে হচ্ছে বাংলাদেশের দুটি প্রবাদ বাক্যের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। একটি প্রবাদ বাক্য হচ্ছে ‘ছলে বলে কৌশলে’। এটা হচ্ছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর। আর বিরোধী গোষ্ঠীর প্রবাদ হচ্ছে ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে’। দুটি খুবই প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি প্রবাদ বাক্য।

মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, এই দুটি বাক্য এক অর্থে সার্বিক পরিবেশটাকে চিত্রায়িত করছে। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো পক্ষপাতিত্বমূলকভাবে ছল-বল এবং কৌশল তিনটিই ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। আর অন্য পক্ষেরও যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে এটাও খুবই স্পষ্ট। তাদের নির্বাচনী ময়দানে টিকে থাকার প্রচেষ্টা চলছে। এভাবে কে কতদূর এগুতে পারে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে আমাদের।

এত কিছুর পরেও নির্বাচনটা আসলে কেমন হবে- এটা বলাটা এখন কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে যেভাবে দেখছি সেখানে অনেক প্রশ্নের বিষয় থেকে যাচ্ছে। কিন্তু আলটিমেটলি প্রতিযোগীদের টিকে থাকার প্রচেষ্টা চলছে। পক্ষান্তরে ভোটাররা যেটা চায় যে ভয়মুক্ত পরিবেশ। সেটা কেমন হবে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কাজেই কেমন নির্বাচন হবে এ বিষয়ে আপাতত আপেক্ষিক উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

গবেষক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনে বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করছে সেটা একটি ইতিবাচক দিক। সকল দলের জন্য যতটা সম্ভব সমান্তরাল ক্ষেত্র বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই দায়িত্বটা নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি পালন করতে পারছে না। অতি অল্প ভুল ভ্রান্তির কারণে বিরোধী দলের এত প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে যে, এটা তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেয় না।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে বিরোধী দলের পক্ষে আগামী নির্বাচন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে তাদের নেতাকর্মীদেরকে একদিক থেকে মামলা মোকাদ্দমায় জর্জরিত করা হচ্ছে, আরেকদিকে তারা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। অথচ নির্বাচনী প্রচারণা নির্বাচনের একটি প্রধান অংশ। বিএনপির জন্য এটি অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ।

ঢাকার একটি শীর্ষ দৈনিকে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে- ‘ধুর ভাই কিসের ইলেকশনের কথা কন? আমি তো কুনো ভুটের আলাপ পাই না। লোকজন সব দাবড়ানির ভয়ে মরতাছে। আইজ অর বাড়ি পুলিশ যায়, কাইল তার বাড়ি ডিবি যায়। ভুটের মইধ্যে যায়া মরবো? আমি গরিব মানুষ। দুকানদারি কইর‌্যা খাই, আমার বাড়িও পুলিশ আসে! আমার ভায়রা আবার বিএনপি করে তো! সেই কারণে তারা ভাবে আমিও বিএনপি।’ পান চিবুতে চিবুতে কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের পঞ্চাশোর্ধ্ব চা- দোকানি হাতেম আলী। লুঙ্গির খুট দিয়ে পানের পিক মুছতে মুছতে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে নিচ্ছিলেন কেউ তার কথাগুলো শুনে ফেললো কি-না।

আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘ভোটের ভাব কেমন বোঝেন?’ তখন তিনি ওই কথাগুলো বলছিলেন। কিন্তু যখন তাকে নিজের পরিচয় জানালাম, তখন তিনি থমকে গেলেন। তারপর মুহূর্তে ইউটার্ন নিলেন। তখন বললেন- উল্টো কথা। তখন তার কথার অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো- ‘খুব সুন্দর ভোটের পরিবেশ আছে। নির্বাচনের আমেজ এখনো নেই বটে, তবে ভোট হচ্ছে বলে সবাই আনন্দে আছে।’
বহু পর্যবেক্ষকই বলছেন- এটাই এখন বাংলাদেশের ভোটের সামগ্রিক পরিবেশ। তফসিল ঘোষণার পরই তো আসলে নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। মসনদ কার, সে রায় জানা যাবে, ৩০শে ডিসেম্বর।

সকাল দেখে দিনটা কেমন যাবে তা বেশিরভাগ সময়ই বোঝা যায়। কখনো কখনো বোঝা যায় না। শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখার জন্য ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষার বিকল্প নেই। মুক্ত মানুষের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ব্যালটের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা নেই-একথা কবুল করতেই হবে।
সূত্র : মানবজমিন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version