এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘নির্বাচনী ইশতেহার: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক সুজন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে নির্বাচনী ইশতেহার বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইশতেহারে এমন বিষয় থাকতে হবে যা সত্যিকার অর্থে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভোটের অধিকার নিশ্চিত হয়। এমন নির্বাচনী রূপরেখা থাকতে হবে যাতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের বিষয়ে আইন তৈরি প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক বলেন, ইসি কর্মকর্তা নিয়োগে একটি আইন তৈরি করতে হবে যাতে সংস্থাটিতে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা লোক নিয়োগ পায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে আর্থিক, শিক্ষাখাতে বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, সংসদকে প্রভাবমুক্ত করতে হবে। যাতে সংসদ সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে এবং এসডিজি, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও দলের ভিশনকে বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অর্জন করা যাবে এমন সংখ্যাগত ও গুণগত টার্গেট নির্ধারণ করে একটি কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সুজন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিগত বিষয়গুলো নিয়ে নির্বাচনী বিতর্কের সংস্কৃতি বাংলাদেশে অনেকটাই অনুপস্থিত। যদিও ১৯৯০ সালের পর প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতিটি দলই জনগণের সামনে ইশতেহার ঘোষণা করে, যা বর্তমানে নির্বাচনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে কী করবে তার একটি আভাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আগামী ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাগরিক সমাজের কিছু প্রত্যাশা রয়েছে, আমরা নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার দেখতে চাই। গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করা, যাতে সত্যিকার অর্থেই জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রয়োজনীয় নির্বাচনী সংস্কারের রূপরেখা প্রদান, যাতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারে।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারের বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রশাসনিক ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে একটি বলিষ্ঠ কর্মসূচি প্রণয়ন এবং এ লক্ষ্যে অন্তত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ন্যূনতম ৫০ শতাংশ (?) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ব্যয় করা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি বলেন, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং-সহ আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নজরদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা; বিগত সময়ে আর্থিক খাতে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ; অর্থপাচার রোধ ও পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা। সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈষম্য নিরসন, সামাজিক সম্প্রীতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, পরিবহন খাতে নৈরাজ্য বন্ধ ও সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তিনি আরো বলেন, জাতীয় সংসদকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে সংসদ যথাযথভাবে সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে; সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা; সংসদ সদস্যদের সততা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের জন্য একটি আচরণবিধি প্রণয়ন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত এবং উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা প্রসঙ্গে ড. বদিউল আলম বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা, যাতে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ প্রদান করা যায়। মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের ব্যাপারে তিনি বলেন, সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ। যেমন, সভা-সমাবেশ, বাকস্বাধীনতা ও সংগঠন করার সাংবিধানিক অধিকারে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না করা। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা চাই। বিশেষ অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করা। ইশতেহার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক বলেন, একশ দিনের কর্মসূচি, এক বছর মেয়াদি কর্মসূচি ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি চাই।
সংবাদ সম্মেলনে সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে ভোট চায়। কিন্তু দেখা যায়, পরবর্তীতে দলগুলো ইশতেহারের কথা অনেকটাই ভুলে যায়। আমরা আশা করি, ভবিষ্যতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন ইশতেহার অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি আইনানুযায়ী সৎ, যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তাহলে সেই কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হবে।
সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকারি দলের লোকজন যেভাবে নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করছেন তাতে মনে হচ্ছে সরকারি দলের লোকজন নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগে নেমেছেন। এ অবস্থায় জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে তাদেরই প্রমাণ করতে হবে তারা দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম, স্বচ্ছ নির্বাচন করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনকে তাদের স্বচ্ছতা ও দায়িত্ব দৃশ্যমান করতে হবে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নির্বাচনী ইশতেহার হলো ভোটারদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের অঙ্গীকার। তবে আমাদের সংবিধানই হলো দলগুলোর মূল ইশতেহার। এর বাইরে ইশতেহারে কিছু থাকলে তা হবে দলীয় কর্মসূচি। ইশতেহার পেশ করার সময় রাজনৈতিক দলগুলো যেন আগের ইশতেহারের একটি কপি সংযুক্ত করে দেয়, যাতে দলগুলো অতীতে ইশতেহার অনুযায়ী কী কী অঙ্গীকার পালন করেছে তা বোঝা যায়।
সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বর্তমানে যে রাজনীতি চলছে তা হলো নেতিবাচক রাজনীতি। বর্তমানে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এবং অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আগে দুষ্টু লোকেরা পুলিশকে দেখলে ভয় পেত, এখন সাধারণ মানুষও পুলিশকে ভয় পায়। অর্থাৎ জনগণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমি আশা করি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরবে এবং ক্ষমতায় এসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।