জোনাস ক্ল্যাস : বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই সহিংস ব্যাপার-স্যাপার। ফলে ৩০শে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন ভিন্ন কিছু হবে না। বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে কারান্তরীণ। তার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ব্যাপক ভাঙচুর ও বেশ কয়েক ডজন ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এটি ছিল নির্বাচনী মৌসুমে প্রথম কোনো সহিংস বিক্ষোভ। কমপক্ষে ৬০ জন বিরোধীদলীয় সমর্থক আটক হয়েছেন। ফলে অভিযোগ ওঠে যে সরকারি দল নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যুগ চিহ্নিত হয়ে আছে অতিমাত্রায় নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সহিংসতার কারণে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস নির্বাচন ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচন, যেটি বিএনপি বয়কট করেছিল।
সেই নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর অবধি কমপক্ষে ৪০০ ভোটার, দলীয় কর্মী, পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হন। বাংলাদেশে সহিংসতা ঘটে চক্রাকারে। আর প্রতিবাদ সহিংস হোক আর নির্দলীয় হোক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সেসব মোকাবিলা করে শক্ত পন্থায়। শাসক দল আওয়ামী লীগ বেশ দৃঢ়ভাবে পুলিশ ও নির্বাচন কর্তৃপক্ষকে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও বরখাস্তের বিষয়টি তো রয়েছেই।
সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের যে নির্বাচন কাঠামো রয়েছে তা খুবই কেন্দ্রীভূত। যারা নির্বাচনে জয় পায় তারা যাবতীয় ক্ষমতা লাভ করে। আর যারা হারে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের স্থান আরো সঙ্কুচিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের জন্য নতুন এক আইন পাস হয়েছে যাতে পুলিশকে দেয়া হয়েছে যেকোনো ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা। আওয়ামী লীগ যত ধরনের উপায় আছে তা ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতিহাস বলে, নির্বাচনী সহিংসতা প্রায়ই ঘটে চক্রাকারে। সেই হিসেবে নির্বাচনের সপ্তাহ কয়েক আগে ও বিশেষ করে ফলাফলের পরে, ফের সহিংস ঘটনাপ্রবাহের দ্বারপ্রান্তে থাকবে বাংলাদেশ।
বিএনপি ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করে সব ধরনের ক্ষমতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল দলটি। দলীয় প্রধানের কারাদণ্ডের ফলে বিরোধী দলটি আছে বেহাল দশায়। কিন্তু ছোট ছোট বিরোধী দলগুলোর একটি জোটের সঙ্গে মিলে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি। এই জোট মালয়েশিয়ার মতো কিছু একটার আশায় আছে, যেখানে বিরোধী জোট অপ্রত্যাশিতভাবে কর্তৃত্বশালী শাসক দলের ৬০ বছরের শাসনের ইতি ঘটায়। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ায় সহিংসতার ঝুঁকি হয়তো হ্রাস পাবে। তবে, নির্বাচন শেষে সহিংসতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ, আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির জন্য পরাজয় মেনে নেয়া কঠিন হবে।
বেশ কিছু উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সূচকে উন্নতি এবং ক্ষমতার ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এর মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ। গেল গ্রীষ্মেই কর্তৃপক্ষ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত বিপুল তরুণদের মোকাবিলা করে। এতে সহিংস সংঘাত দেখা দেয়। ঢাকা একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, এসব আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস সত্ত্বেও বাংলাদেশে নির্বাচনী সহিংসতা হ্রাস করা সম্ভব। ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি ও সম্প্রদায়বিশেষের সুরক্ষা বৃদ্ধি করতে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রচেষ্টা হাতে নেয়া উচিত। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক মোতায়েন এবং বেসামরিক শিক্ষাদান প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা হলেও একইভাবে উত্তেজনা হ্রাস করা সম্ভব।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো, সংঘাতপ্রবণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিরোধমূলক যেসব ব্যবস্থা সচরাচর প্রয়োগ করা হয়, সেসব বাংলাদেশে বেশ দুর্বল কিংবা অনুপস্থিত। নাগরিক সমাজ, এমনকি আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের জন্য সুযোগ সেখানে সীমিত। সাংবাদিকরা প্রায়ই হেনস্থার শিকার হন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও প্রায়ই ছড়িয়ে পড়তে পারেন না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা প্রায়ই এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে পারেন না। মাঝেমাঝে তারা চানই না এই ভয়ে যে যদি সম্ভাব্য এই সমস্যাসঙ্কুল নির্বাচন প্রক্রিয়া বৈধতা পেয়ে যায়!
(জোনাস ক্ল্যাস ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি)-এ জ্যেষ্ঠ প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার লেখাটি ইউএসআইপি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।)