এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : খালেদার মনোনয়ন বাতিল করে রিটার্নিং অফিসারের দেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে ভোটাভুটির পর তার আপিল বাতিল ঘোষণা করা হয়। একজন নির্বাচন কমিশনার আপিল মঞ্জুর করে খালেদার প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য তিন
নির্বাচন কমিশনার আপিল খারিজের পক্ষে অবস্থান নেন। গতকাল তিনটি আসনে খালেদার মনোনয়ন বাতিলের ওপর শুনানির সময় ইসি থেকে এ বিভক্ত রায় আসে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আপিল খারিজ হওয়ায় খালেদা জিয়া আপাতত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন খালেদার আইনজীবীরা। আপিল শুনানিকে কেন্দ্র করে এজলাসে আওয়ামী লীগ-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনাও তৈরি হয়।

কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়া বগুড়া-৬, ৭ এবং ফেনী-১ আসনে নির্বাচন করার জন্য সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। গত ২রা ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে তিন আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার মনোনয়ন বাতিল করে দেন। এর বিরুদ্ধে গত ৫ই ডিসেম্বর আপিল করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। শনিবার দুপুরের আগেই খালেদা জিয়ার তিনটি আপিল একই সঙ্গে শুনানি হয়। আইনজীবীদের দাবি, রিটার্নিং কর্মকর্তারা খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন নির্বাচনী অপরাধের অভিযোগে। কিন্তু, বিএনপির চেয়ারপারসনের সাজা হয়েছে দুর্নীতি মামলায়, নির্বাচনী অপরাধে নয়।

প্রায় ১৮ মিনিটের চলা টানা শুনানিতে রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে নির্বাচন কমিশন। বিকাল ৫টায় পুনরায় শুনানির কথা জানিয়ে দেন কমিশন। এরপর প্রায় পৌন ১ ঘণ্টা পাঁচজন কমিশনার সিইসির দপ্তরে বৈঠকে বসেন। বিকাল সাড়ে ৩টায় পুনরায় আপিল শুনানিতে অংশ নেন।

সন্ধ্যায় কমিশন পেন্ডিং আপিলগুলো শুনানির অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার আপিলের বিষয়টি আসে। এ সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নাল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন যুক্তিতর্কে অংশ নেন। তারা আইনের ধারা উল্লেখ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে রায় দাবি করেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বিপক্ষে মত তুলে ধরেন। বিএনপিপন্থি আইনজীবী ছাড়াও এসময়ে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের বেশ কয়েকজন আইনজীবী এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। সিইসি রায় ঘোষণা করতে যাবেন-এমন সময়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মাইক্রোফোন হাতে নেন। তিনি বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক যথাক্রমে বগুড়া-৬, ৭ ও ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে যে আপিল দায়ের করা হয়েছে, তা আইনগত বিশ্লেষণ করে আমার রায় এই আপিল মঞ্জুরের পক্ষে। আমি এই আপিল মঞ্জুর করলাম। মাহবুব তালুকদারের এই ঘোষণার পরপরই বিএনপির আইনজীবীরা উল্লাস করে কোর্ট রুমের পেছনের দিকে চলে যেতে উদ্ধত হন। অন্যদিকে আওয়ামী আইনজীবীরা এর বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ সময় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আপনারা ঠাণ্ডা হয়ে বসুন। এই রায় পূর্ণাঙ্গ নয়, এটি মাত্র একজনের রায়।

তখন উত্তপ্ত আদালত কক্ষেই কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম মাইক্রোফোন নিয়ে তার রায় ঘোষণা শুরু করেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা নির্বাচন করতে পারেন না। আপিল মঞ্জুর করা যায় না। এ কারণে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করা হলো। এরপর কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, আপিল নামঞ্জুর করা হলো। কমিশনার কবিতা খানমও এই দুই কমিশনারের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কারাগারে আছেন। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নৈতিক স্থখলনজনিত কারণে দণ্ডিত হয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) এখন কারাগারে। তার দণ্ড স্থগিত হয়নি। মনোনয়নপত্র বাতিল করে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা যে আদেশ দিয়েছেন, তার স্পিরিট বিবেচনা করে আপিল নামঞ্জুর করছি।

সবশেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, আমি আমার কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন এই তিনজনের পক্ষে রায় দিলাম। এই আপিল আবেদন মঞ্জুর হয়নি।’ সিইসিসহ চার কমিশনার আপিল নাকচ করার পক্ষে রায় দিলে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা উল্লাস প্রকাশ করেন। এর পরপরই ইসি সচিব বলেন, খালেদা জিয়ার আপিল গৃহীত হয়নি। ‘৪-১ ভোটে এই আপিল নামঞ্জুর হলো। ফলে বিএনপির চেয়ারপারসন ভোটে অংশ নিতে পারছেন না।

শুনানিতে খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি
শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়া তিনটি আসন থেকে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা ১২/১ (ঘ) অনুসারে মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন। এই ধারা নির্বাচনী অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত। রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র বাতিলের আদেশে যা বলেছেন তা হলো, নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে যদি কেউ অপরাধ করেন, যেমন- মনোনয়নপত্র দাখিলের পর কেউ প্রচারণা শুরু করলো বা কাউকে মারধর করলো বা ভোটকেন্দ্রে কোনো বাধা সৃষ্টি করলো। অর্থাৎ, নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করলো। তারা বলেন, মনোনয়নপত্র বাতিল আদেশে খালেদা জিয়ার সাজার কোনো প্রসঙ্গে বলা হয়নি। এখানে বলা হয়েছে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়।

খালেদা জিয়া বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সেখানে থেকে তিনি কীভাবে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করবেন? যে আদেশ রিটার্নিং কর্মকর্তারা দিয়েছেন, আইনের দৃষ্টিতে তা বৈধ নয়। আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে যথাযথ আদেশ দেবে। রিটার্নিং কর্মকর্তারা যে আদেশ দিয়েছেন, কমিশন তা বাতিল করবে। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নেবেন।’ আইনজীবীদের মতে, রিটার্নিং কর্মকর্তা যে আদেশ দিয়েছেন এখন তার ওপরই কমিশন আদেশ দিতে পারবে। এর বাইরে যাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নাই।

রায় ঘোষণা শেষে ব্যারিস্টার খন্দকার মাহবুব উদ্দীন খোকন বলেন, নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার অভিযোগ ছিল-খালেদা জিয়া নির্বাচন সংক্রান্ত অপরাধ করেন নাই। শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তিনটা আপিল মঞ্জুর করেছেন। খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়ার আর কোনো আইনগত বাধা নাই। গত তিনদিন আমরা দেখেছি, আপিল শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে কখনো সিইসি, কখনো অন্য কমিশনাররা রায় ঘোষণা করেছেন। তারা কমিশনের সকলের পক্ষ থেকেই রায় ঘোষণা করেছেন।

সবাই ধারণা করেছিল মাহবুব তালুকদারের রায় সবার রায়। এটা সবার রায়। সেই রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার তিনটি মনোনয়নপত্রই বৈধ করেছেন। একবার রায় ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর, দ্বিতীয়বার রায় ঘোষণার কোনো সুযোগ নাই। গত তিনদিনে আপনারা দেখেছেন, দ্বিতীয় রায় হয়েছে? নির্বাচন কমিশনে বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। মাহবুব তালুকদার সাহেব যে জাজমেন্ট দিয়েছেন। মাহবুব তালুকদারের জাজমেন্ট লিগ্যাল জাজমেন্ট, ফেয়ার জাজমেন্ট। আমরা আইনগত এক্সামিন করে উচ্চ আদালতে যাওয়া যায় কি-না, এ বিষয়ে কনভিন্স হলে সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা বিশ্বাস করি উচ্চ আদালত তার মনোনয়নপত্র বৈধ করবে।

উল্লেখ্য, একাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের ৩০০ আসনে মোট ৩০৬৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। রিটার্নিং অফিসাররা যাচাই-বাছাই করে তার মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াসহ ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করে বাতিল করেন। গত সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন এসব বাতিল মনোনয়নের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহণ শুরু করে। মনোনয়ন বাতিলকৃত ৫৪৩ জন আপিল করেন। গত বৃহস্পতি ও গতকাল পর্যন্ত আপিল আবেদনের ওপর শুনানি করে ইসি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version