এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নতুন কিছু নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকার রচিত ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ গ্রন্থ রচনা, তারেক রহমানের বক্তব্যে বিভিন্ন সময় জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করা, সুপ্রিমকোর্টের প্রদত্ত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার রায়ের পর্যবেক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে উদ্দেশ্যমূলক উল্লেখ একই সূত্রে গাঁথা।

এমনই একটি প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্ম যদি অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে কেবল ইতিহাসনির্ভর না হয়ে তৎকালীন দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের পর্যালোচনা করে, দেখতে পাবেন খবরের শিরোনাম ও বিবরণীর নাম চরিত্র বঙ্গবন্ধু। তিনি খবর কেন বা তাকে নিয়েই খবর কেন, তার সঙ্গেই পাকিস্তানি পক্ষের আলোচনা কেন, তাকে ঘিরেই সবকিছু আবর্তিত কেন- এসব প্রশ্নের এককথায় জবাব হল তার নির্দেশ এবং নেতৃত্বেই আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে বলেই সবকিছুর কেন্দ্রে আছেন তিনিই।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা ব্যক্তিগত মান-অভিমান-বিরাগের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত বা ব্যক্তির ঐতিহাসিক অবদানকে আড়াল করা অন্যায়। ইতিহাস গ্রন্থ রচনার নামে এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক আচরণ গর্হিত অপরাধ। তাই ২০১৪ সালে প্রকাশিত ১৯৭১ ভেতরে বাইরে গ্রন্থের তথ্য উপস্থাপনের অসংলগ্নতা, অসারত্ব ও অসঙ্গতি নিয়ে বিজয়ের মাসে আলোচনা করতে চাই।

বইটির পৃষ্ঠা ৩২-এ লেখক বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে আপামর বাঙালির ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রশ্নাতীত ও ইতিহাসনিষ্পন্ন বাস্তবতাটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি এর সমর্থনে অদ্ভুত একটি কথা বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জয় বাংলার সঙ্গে সেদিন জয় পাকিস্তানও উল্লেখ করেন। প্রশ্ন হল, ১৯৯১-১৯৯৬ ক্ষমতাকালীন বিএনপি সরকার চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরে সংরক্ষিত এ ভাষণের সেল্যুলয়েড টেপটি ধ্বংসের নির্দেশ না দিয়ে এই পাকিস্তান বলাটিকে প্রমাণ করতে টেপটি ব্যবহার করল না কেন?

স্বাধীনতার ৪৩ (গ্রন্থ প্রকাশের সময়কাল ২০১৪ পর্যন্ত) বছরে কোনো লেখায়-বিবৃতিতে কোনো ইতিহাসবেত্তা বা প্রত্যক্ষদর্শী এটা উল্লেখ করলেন না, ২০১৪ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থে কেবল এমন তথ্য দেয়া হল! ১৯৭৫ সালের পর একুশ বছরে ও ২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে তা থেকে আরও বেশি ফায়দা লাভে বিএনপির কেউ-ও উল্লেখ করল না!

এরও পরে ২০০৯-২০১৩ বিএনপি বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখায় অনাপোস নীতির সমালোচনার্থে কখনও ‘জয় পাকিস্তান’-এর অপপ্রচারের ধৃষ্টতা দেখাল না! ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এর কোনো উল্লেখ থাকল না, এমনকি যারা ভাষণের ‘ভাতে মারব, পানিতে মারব’ কথাটিরও অপব্যাখ্যা করতে দ্বিধান্বিত ছিল না, সেসব সাংবাদিকের চোখ এড়িয়ে থাকল বিষয়টি!

অন্যূন একজন প্রত্যক্ষ শ্রোতার জবানিতে বা রেকর্ডিং থেকে এর উল্লেখ পাওয়া গেল না! অধিকন্তু জয় বাংলার সঙ্গে ছন্দেও বেমানান যে কথাটি, সেটাই খন্দকার সাহেব স্মৃতিকথায় লিখলেন! পাকিস্তানের অনেক সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও ১৯৭১ নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। তারাও কেউ এমন কথা বলার রুচিহীনতা দেখায়নি। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণটি সংরক্ষণের জন্য বিবেচিত হওয়ার প্রক্রিয়ায়ও সামান্যতম বিতর্কের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সে ক্ষেত্রে এই নিরেট মিথ্যাচারের জন্য জবাবদিহি লেখকের নিকট থেকে আর কবে পাওয়া যাবে?

পৃষ্ঠা ৫৩-এ উল্লেখিত ‘অস্থায়ী সরকার গঠন’ কথাটি অসঠিক ও উদ্দেশ্যমূলক অন্যায় উল্লেখ। ‘অস্থায়ী সরকার’ অভিধাটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক রেকর্ড, সংবিধান, বাস্তবতা কোনোটিই বৈধতা দেয় না। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ গঠিত ও বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কোনোভাবেই অস্থায়ী সরকার বলা যায় না। বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চের ওয়ারলেস ঘোষণা অথবা ১৯৭১ সালের জুন মাসে ভারত সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দকে (যেদিনও সরকারের উল্লেখ না করে শুধু বাংলাদেশের নেতাদের বলা আছে, পৃষ্ঠা ৫৭) জিজ্ঞাসা করলে নিরুত্তর থাকাসহ বহু বিতর্ক উস্কে দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হল, ১৭ এপ্রিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পঠিত হওয়ার পর ভারতীয় সরকারের নামে এ উল্লেখ সর্বৈব মিথ্যাচার। স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র (তৃতীয় খণ্ড) থেকে ২০০৪ সালে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেয়ার কথাটি (পৃষ্ঠা ৫৮) নির্লজ্জভাবে যুক্তি হিসেবে এখানে উল্লেখ করা আছে। প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার লিখিত ও প্রচার হওয়ার সহস্র তথ্য-প্রমাণ আছে। ইপিআরের ওয়্যারলেস, টেলিগ্রামযোগে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা ও নির্দেশনা প্রেরণ প্রশ্নাতীত ঘটনা।

৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লখ করেন ‘২৮ মার্চ আমি দুই সপ্তাহের ছুটির আবেদন করি এবং যুদ্ধের এ পরিস্থিতিতেও কর্তৃপক্ষ এত লম্বা ছুটি মঞ্জুর করে। পাকিস্তানিরা চাইছিল যে, অফিসে ওরা কী করছে ওবং ওদের কী পরিকল্পনা, এসব গোপনীয় বিষয় যাতে আমরা জানতে না পারি।’ কিন্তু এ বক্তব্য নিয়ে পাঠক মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রস্তুতি বা মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতার জন্য একজন বাঙালি অফিসার ছুটি নিতে পারে এ প্রসঙ্গই তো পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আসার কথা।

৭৯ পৃষ্ঠায় পাই ‘… ১৫ মে সকাল ১০টায় আমরা সবাই নিরাপদে আগরতলার কাছাকাছি মতিনগর বিএসএফ ক্যাম্পে পৌঁছালাম।’ এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উল্লেখ পাই জুনের একদম শেষে, ২৮ তারিখে। দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রলম্বিত হওয়ার মামুলী কারণ পাঠককে খুব সন্তুষ্টি প্রদান করেনি।

১১৩ পৃষ্ঠায় ‘১৯৭১-এর জুলাই মাসে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর অধিনায়কদের সম্মেলন’ ক্যাপশনে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেটি প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দফতরের সামনে তোলা। এটি মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে কিছুদিন জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর কার্যালয় ছিল।

পৃষ্ঠা ১৪৫-এ লেখক মুজিব বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন শৃঙ্খলাবোধের ঘাটতির কথা বলেন। অথচ উপ-অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরকালে তিনি এ নিয়ে কোনোদিন কোনো অফিশিয়াল রিপোর্ট পেশ করেননি।

২১৫ পৃষ্ঠায় লেখক বলতে চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমানকে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে সেনাপ্রধান হতে দেয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ তার পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমির সহপাঠী, জিয়া পাকিস্তানি আর্মি (পিএ) নম্বর অনুসারে অগ্রবর্তী মাত্র। উল্লেখিত ‘সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন’ বলে সেনাবাহিনী প্রধানের নিযুক্তিতে বাস্তবত কোনো আইন নেই।

১০-১১ পৃষ্ঠায় ভূমিকায় তিনি স্বগোক্তি করেছেন যে, বইটি অনুলিখনের মাধ্যমে প্রস্তুত হয়েছে। অতএব ট্রান্সক্রিপশনে সঙ্গতই এর যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন প্রসঙ্গে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার নাম আমরা পাই, যার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লি­ষ্টতা আছে। অধিকন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনতিপরই এ রকম বিতর্কের উদ্রেককর লেখনী ব্যক্তির নৈতিকতাবোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ জাতির সেরা অর্জন। এই সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একটি বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে, তা হল আমরা পারি। দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অমূল্য শিক্ষা আমরা পাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালির জন্য অপরিসীম ত্যাগ, প্রতিশ্রুতিশীলতা এবং সর্বোপরি অবিসংবাদিত নেতৃত্ব সর্বকালের প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়। কারও কারও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক এ ক্ষেত্রে ভাষাহীন নিন্দনীয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে ইতিহাসকে কলুষিত করার অপচেষ্টা তাই পরিহার করাই কাম্য।
লেখক – আসিফ কবীর : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version