এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ‌বৃটেনের ইয়েলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাক্টন আসন থেকে নির্বাচিত বিরোধী লেবার দলের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ড. রূপা হক বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কমনওয়েলথের মাধ্যমে অবাধ নির্বাচনের অঙ্গীকার করতে হবে শেখ হাসিনার সরকারকে। সোমবার বৃটেনের অনলাইন পলিটিক্স হোম ডট কমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‌’আমাকে তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপির একজন বলা হয়ে থাকে। আমার জন্ম হ্যামারস্মিথে। ১৯৮৯ সালে ১৭ বছর বয়সে আমি প্রথম বাংলাদেশে যাই। আমি যখন আমার বর্তমান আসন ইয়েলিং-এ বড় হয়েছি তখন আমার বাবা-মার কাছ থেকে বাংলাদেশ সমপর্কে ধারণা পেয়েছি। তারা স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান (যা বর্তমানে বাংলাদেশ) ছেড়ে চলে আসেন। আমার নানী একবারও বাড়ি না ছেড়ে একাধিক দেশে বসবাস করা নিয়ে মজা করতেন। এর শুরু হয়েছিল বৃটিশ-ইন্ডিয়া দিয়ে।

এত বছর ধরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আমি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটি ভয়ানক দিক দেখতে পেয়েছি।’

ড. রূপা হক বলেন, ‘তারা কণ্ঠরোধের মাধ্যমে সমালোচনার সব ধরনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। গত বছর সংসদীয় প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে বাংলাদেশে গিয়ে আমরা দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো তিনিও গত চার দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। গত বছর তিনি গৃহবন্দি হয়েছিলেন। এ বছর স্পষ্টতই তিনি জেলবন্দি। শুধু তিনি একাই নন। দলীয় রাজনীতি ছাড়াও আপনি সেখানে সরকারের নির্যাতনের শিকার হতে পারেন।

গত সপ্তাহে, ১০০ দিন পর সুখবর আসে যে খ্যাতনামা ফটো-সাংবাদিক শহিদুল আলম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর অভিনেত্রী শ্যারোন স্টোনসহ ১০ জন নোবেলজয়ীর সমর্থন পেয়েছেন তিনি। তার পরিবারের সদস্যরা আমার সংসদীয় আসনের। তারা গ্রীষ্ম থেকে নির্যাতনসহ শহিদুল আলমের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে আমাকে অবগত করেছেন। এখন মনে হচ্ছে, বিশ্বের চোখ রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সরে গেছে। ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমার থেকে আসা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু নিজের ঘরেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে চলেছে। তাছাড়া, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি।

তাই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকার অধিকারের জন্য আবেদনও করতে পারছে না।
এরইমধ্যে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে শহিদুল আলমের নিপুণ কাজ ব্যাপক আন্তর্জাতিক মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়েছে। রোহিঙ্গা শিশুরা এ শতকে কোনো জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া সব থেকে ঘৃণ্য ও সহিংস হামলার মুখ থেকে পালিয়ে এসেছে। গণহত্যার বীভৎসতার সঙ্গে এসব শিশুর সুন্দর শৈশবে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষকে তুলে এনেছেন শহিদুল আলম। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বৃটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যালিস্টার বার্ট এমপি বলেছেন, আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সম্মান জানাতে হবে। আবার পার্লামেন্টে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আমাকে বলেছিলেন, পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়াচলিস্টে থাকা ৩০টি রাষ্ট্রের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এ তালিকায় থাকা অন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বার্মা, রাশিয়া, সৌদি আরব, সিরিয়া ও উত্তর কোরিয়াও রয়েছে। তার এ দুই বিবৃতি একটি অন্যটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

জুলাই মাসে, দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ঢাকার রাস্তায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামে। দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনা একটি বড় সমস্যা হওয়ায় আন্দোলনটি ব্যাপক জনসমর্থন পায়। আন্দোলন থামাতে কর্তৃপক্ষ তখন জলকামান ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। যারা তরুণদের আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করছিলেন তাদেরকে লোহার দণ্ড দিয়ে মেরে আহত করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শহিদুল আলমও ছিলেন তাদের একজন।

দুঃখজনক হলেও এটি বাংলাদেশে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এ বছরের মার্চ মাসে, থিংক ট্যাংক বেরটেলসম্যান স্টিফটুইং বাংলাদেশকে স্বৈরশাসনের অধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জোরপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছে। প্রায়ই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরাই টার্গেট হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কঠিন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস পাচ্ছে এবং শাস্তিস্বরূপ কারাদণ্ড দেয়া হচ্ছে।

আল-জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে শহিদুল আলমকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি সরকারের পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকাকে তুলে এনেছেন। তিনি বলেছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাতে বর্তমান সরকার হেরে যাবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে জন-অসন্তোষ জমা হয়েছে। বিশ্বায়িত মিডিয়ার যুগে বিশ্বব্যাপী তার এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। প্রচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, ২০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তার বাসায় গিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। আমি আপনাদের তার উপরে হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেব কিন্তু জামিনে তার মুক্তি মানে এই না যে, তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটি শুধু একটু বিলম্ব। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। রোহিঙ্গাদের সাহায্য নিয়ে প্রশংসা ব্যতীত বর্তমান শাসক দলের বৈধতা ও ক্ষমতা নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ ছুড়লে তাকে নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, গত সরকারের কোনো ভালো দিক ছিল না। কিন্তু দুটি খারাপ কাজ কখনো একটি ভালো কাজ হতে পারে না। সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করা হলে দেশটি কেঁপে উঠবে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে কমনওয়েলথের চেয়ার ইন অফিস। কমনওয়েলথের মাধ্যমে আমাদের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাংলাদেশিদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করতে হবে। তাই, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের আচরণকে চ্যালেঞ্জ করতে বৃটিশ সরকারের মন্ত্রীদের আরো অনেক কিছু করতে হবে। আমরা শুধু রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের ওপর জোর দিচ্ছি। কিন্তু এখনি সময় বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার নিশ্চিতের ওপরেও জোর দেয়ার। তারা কথা বলার জন্য কিংবা শহিদুল আলমের মতো শুধু নিজের কাজ করার জন্য কারাদণ্ড ও নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। সূত্র : মানবজমিন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version