এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : তৃতীয়বারের মতো রোববারও হামলা চালানো হয় আফরোজা আব্বাসের গণসংযোগে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর পর থেকে বিরোধী জোটের প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। রোববার পর্যন্ত সারা দেশের অন্তত ৫০ জেলায় দুই শতাধিক হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় আহত হয়েছেন ১ হাজার ১৯৫ জন। পাশাপাশি বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তার থেমে নেই। এখন পর্যন্ত বিরোধী জোটের দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সংঘাত ও নাশকতার অভিযোগ এনে ৩ সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি গ্রেপ্তার ও হামলার সংখ্যা আরও বেশি।

তাদের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তার করার জন্য প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছেন।

গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেক নেতাকর্মী পলাতক রয়েছেন। তারা দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারণায়ও অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। এছাড়া প্রচারণায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের ওপর প্রকাশ্য গুলি চালানো হচ্ছে।

প্রতীক বরাদ্দের পর ১১ই ডিসেম্বর থেকে প্রচারণায় নামেন বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা। প্রচারণার প্রথম দিনে ঠাকুরগাঁয়ের বেগুনবাড়ি এলাকায় দুপুর ১টার দিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের গাড়িতে হামলা করা হয়। হামলায় ৮/১০ জন নেতাকর্মী আহত হন। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল পুলিশের ছত্রছায়ায় সেদিনের হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা থেকে রেহাই পাননি ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, বিএনপি মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে মিরপুরে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় তার সঙ্গে থাকা জাসদের আ স ম রব, বিএনপির আব্দুস সালাম, গণস্বাস্থ্যর ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ঐক্যফ্রন্টের মনোনিত প্রার্থী রেজা কিবরিয়া হামলার শিকার হন। হামলায় বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় পরের দিন ড. কামাল হোসেনের পক্ষে ঢাকা-১৪ আসনের বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে দারুস সালাম থানায় মামলা করেন। কিন্তু এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে নাই পুলিশ।

ফের আফরোজা আব্বাসের গণসংযোগে হামলা: ঢাকা-৯ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের গণসংযোগে ফের হামলা চালিয়েছে সরকারি দল সমর্থকরা। গতকাল রোববার দুপুর ১টার পর মুগদা মানিকনগর পুকুরপাড় এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় নারী ও সাংবাদিকসহ অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আফরোজা আব্বাস। হামলার পর আফরোজা আব্বাস গণসংযোগ বন্ধ করে বাসায় ফিরে আসেন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আফরোজা আব্বাস বলেন, আমি এর আগেও মিছিল করেছি। সেখানেও হামলা করেছে। আজকে আবার নির্লজ্জের মতো আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। হামলায় আমার মাথায় ও পায়ে আঘাত লেগেছে। আমার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরাও আহত হয়েছেন। এই হামলা হয়েছে ঢাকা-৯ আসনের নৌকার প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্দেশে। আসলে উনি চাচ্ছেনটা কী? আমরা ঘরে বসে থাকবো আর উনি একা একা প্রচার চালাবেন? তাহলে বলে দিলেই পারেন। তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তায় পুলিশ ছিল। কিন্তু পুলিশের প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা আছে। তারা মাঠে নামলে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

গতকাল দুপুর ১২টায় শাহজাহান পুরের নিজ বাসা থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল সহকালে গণসংযোগে বের হন আফরোজা আব্বাস। মিছিলটি খিলগাঁও, বাসাবো, বৌদ্ধমন্দির, মুগদা হয়ে মানিকনগরের দিকে যায়। মানিকনগর মোড় কাচাবাজার এলাকায় পৌঁছলে দুপুর ১টার পর মিছিলের পেছন থেকে হামলা চালায় সরকারি দরের সমর্থকরা। আফরোজা আব্বাসের পক্ষ থেকে হামলাকারী ও আহত নেতাকর্মীদের একটি তালিকা দেয়া হয় গণমাধ্যমকে। এতে বলা হয়- মান্ডা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি শামীম, সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল, মুগদা থানা ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেল, সাধারণ সম্পাদক শাম্পু, মুগদা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শামীম হোসেন, শাহাজাদা বাবু, আওলাদ, রুবেল, জীবন, মানিকনগর যুবলীগ নেতা জীবন, মান্ডা যুবলীগ নেতা হাজী বিপ্লব, সাধারণ সম্পাদক জাবেদ, বিচ্ছু রনি, চাঁনতারা ফারুক, পিচ্ছি রাসেল, শাহিন, প্লাবন, মান্ডা আওয়ামী লীগ নেতা হাজী আনোয়ার, মুগদা আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া রাজা, হিরু মেম্বার, সোলেমান মেম্বার, শ্রমিক লীগের তোতলা কালাম এ হামলায় অংশ নেয়। এ ঘটনায় হায়দার আলী, নামে একজন ফটো সাংবাদিক মারাত্মক আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়।

একইসঙ্গে তাকে মাটিতে ফেলে উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে ও পিটিয়ে আহত করে। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে আরো আছেন, আসাদ, মিন্টু, পারভেজ। এছাড়া, দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মহিলা দল নেত্রী নূরজাহান আক্তার ইভা, শোভা, মনোয়ারা রহমান, জয়া, শারমিন আক্তার, মিজানুর রহমান, সোনিয়া আহমেদ, পারভিন, মর্জিনা আক্তার, ফরিদা পারভিন, সুলতানা রাজিয়া, আসিফ, সোহেল, ইসমাইল, কাজী আকবরসহ প্রায় ১০০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এর আগে ১৮ই ডিসেম্বর দক্ষিণ গোড়ানের বেগুনবাড়ি এলাকার তার গণসংযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। ১৫ই ডিসেম্বর সেগুনবাগিচার কাঁচাবাজার এলাকায় মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা করা হয়। এসময় তার সমর্থক ও দলীয় নেতাকর্মীসহ ৫০/৬০ জন আহত হন। ওই দিন ৩০-৪০ জন দুর্বৃত্ত রড, লাঠি, চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়।

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি আসনে বিএনপির মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারের প্রচারণার গাড়ি বহরে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল দুপুরে দক্ষিণ ফটিকছড়ির মোহাম্মদ তকিরহাটে হামলার এ ঘটনা ঘটেছে। হামলায় সন্ত্রাসীদের লাঠির আঘাতে কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারের মাথা ফেটে গেছে। এছাড়া সাবেক বিচারপতি ও বিএনপি নেতা ফয়সল মাহমুদ ফয়েজী, ছাত্রদল সভাপতি টিপু, চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আজম খান, আহমেদ রশীদ তালুকদার, আমিন তালুকদার, মোরশেদ হাজারী, ইঞ্জিনিয়ার মুন্না, ওমর ফারুক, সায়েদুল আনোয়ার মাসুদ, সাকিব নুরুল ইসলাম রিপন, মামুন, সাইমন, হাসান মাহমুদ হামিম, সাইফুল ইসলাম টিটু, সায়ফুল হায়দার রাশেলসহ অন্তত ৩০ বিএনপি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন আহতদের উদ্ধার করে ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে নেয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে জানান কর্নেল বাহারের ব্যক্তিগত সহকারী মো. ইব্রাহিম।

ফটিকছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাবুল আক্তার হামলার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বিএনপি প্রার্থী গণসংযোগের সময় মোহাম্মদ তকিরহাট এলাকায় সন্ত্রাসীরা হামলা করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ফটিকছড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তারা চিকিৎসা নিয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার সময় সেখানে পুলিশ ছিল না। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে। এ ব্যাপারে আজিমুল্লাহ বাহার বলেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার জন্য সুপরিকল্পভাবে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লালিত গুণ্ডারা হামলা চালিয়েছে।

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রাম-৫ হাটহাজারী আসনে বিএনপি জোটের মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ ইবরাহিম বীর প্রতীকের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। রোববার বিকাল তিনটার দিকে হাটহাজারীর ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১নং গেইট এলাকায় নাজিরহাট মহাসড়কের ওপর হামলার এ ঘটনা ঘটে। এতে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ বিএনপির ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। নেতাকর্মীরা জানান, সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বিকালে ফতেপুর ইউনিয়নে কর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ করছিলেন। পরে অন্য এলাকায় যাওয়ার সময় ১০-১৫ জন দুর্বৃত্ত সৈয়দ ইবরাহিমের গাড়ি বহরের গতিরোধ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও চিকনদন্ডি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মহসিনসহ ১০-১২ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এসময় সৈয়দ ইবরাহিম এর ব্যক্তিগত গাড়িসহ চারটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ব্যাপারে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক বলেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শামিমের বড় ভাই মো. সেলিম ও শাহ আলমের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়েছে। আমাকে লক্ষ্য করেই তারা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। ভাগ্যক্রমে আমি বড় ধরনের আঘাত থেকে রক্ষা পেলেও আমার সঙ্গীরা গুরুতর আহত হয়েছেন। হাটহাজারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর হামলার বিষয়ে কিছুই জানে না বলে জানান। তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিচ্ছি।

নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালমা ইসলামের প্রচারণার গাড়িতে হামলা চালিয়েছে দুর্র্বত্তরা। এতে নারী শিল্পীসহ সাত বাউল শিল্পী আহত হয়েছেন। তাদের দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আজ দুপুরে নারিসা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার দোহারের মেঘুলার ধোপাবাড়ী মাঠে বিকাল সাড়ে ৩টায় মোটরগাড়ি প্রতীকের নির্বাচনী সভা ছিল। কিন্তু বেলা ৩টার দিকে একদল সশস্ত্র ক্যাডার মোটরসাইকেলে এসে ওই নির্বাচনী সভার প্যান্ডেল, চেয়ার ভাঙচুর করে। তারা প্যান্ডেলসহ দুই শতাধিক চেয়ার ভেঙে পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়। ভাঙচুরের সময় তাদেরর হাতে লাঠিসোটা এবং দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। অন্যদিকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে দোহার থানার মোড়ে মোটরগাড়ি প্রতীকের একটি মাইক্রোবাসে হামলা ও ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। দোহার সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মোটরগাড়ি প্রতীকের গাড়ি ভাঙচুর কোনো তথ্য আমার জানা নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version