এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ক্রমশ সংঘাতময় হয়ে উঠছে নির্বাচনী পরিবেশ।

অব্যাহত সহিংসতায় সাধারণ ভোটাররা উদ্বিগ্ন। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনেই ছড়িয়ে পড়ছে সংঘাত। হামলা শুধু কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, খোদ প্রার্থীরাও এর শিকার হচ্ছেন।

এমনকি সাবেক মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। দলীয় অফিস বা নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। মিছিলে চালানো হচ্ছে সশস্ত্র হামলা।

সোমবার ২৫ জেলায় নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েকজন প্রার্থীও হামলায় আহত হন। ঢাকার নবাবগঞ্জে সাংবাদিকদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা চালানো হয়।

মঙ্গলবারও বেশ কয়েক জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অতীতে কোনো নির্বাচনের আগে এমন ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, অব্যাহত সহিংসতায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশের জনপ্রত্যাশা ম্লান হতে যাচ্ছে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ)’ তৈরি করতে নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তায় মনে হচ্ছে- তারা এসব সহিংসতাকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না।

তাদের দুর্বলতার কারণেই সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন নির্বাচনী মাঠে যে পরিস্থিতি চলছে, তা সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে এখনও সময় আছে। নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কঠোর মনোভাব নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করলে সহিংসতার মাত্রা অনেকটাই কমে আসবে।

আর সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

হামলার পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, বেশির ভাগ জায়গায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরাই এ হামলার শিকার হচ্ছেন। তবে কয়েকটি জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ক্যাম্পেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সীতাকুণ্ডে আওয়ামী লীগের মিছিলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে।

বিএনপির নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের ওপর হামলার পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ বিরোধীদের। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলছেন।

অনেক স্থানে পুলিশ বিরোধীদের মিছিলে হামলা চালাচ্ছে আবার কোথাও কোথাও পরোক্ষভাবে তারা হামলায় সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

সরকারবিরোধীদের অভিযোগ, হামলার শিকার নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চেয়েও পাচ্ছেন না। এমনকি নির্বাচন কমিশনে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। যদিও নির্বাচনকেন্দ্রিক যে কোনো সহিংসতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, নির্বাচন কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব, সেটি তারা প্রয়োগ করছেন না।

আর করবেন বলেও মনে হয় না। মোদ্দাকথা, আমরা যা দেখছি, তা ভালো দেখছি না। জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

তাদের অপারগতা এবং দুর্বলতার কারণেই এ সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে। এটা অব্যাহত থাকলে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি উন্নতিতে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখার সুযোগ নেই। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। তবে তাদের নিরপেক্ষ হয়ে নির্লিপ্ত থাকলে চলবে না। নিরপেক্ষতার পাশাপাশি তাদের সক্রিয় হতে হবে। আশা করি, তারা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করবে।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ১১ ডিসেম্বর প্রতীক পাওয়ার পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ২০০ হামলা, সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুই নেতাকর্মীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। সব দলের প্রায় ৭০০ নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হয়েছেন। হামলার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে অর্ধশত প্রার্থী।

শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপি প্রার্থী মিয়া নুরুদ্দিন অপুকে গুরুতর আহতাবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সোমবার ২৫টি নির্বাচনী আসনে হামলা হয়েছে।

ধানের শীষের ১৯ প্রার্থীসহ আহত শতাধিক। মঙ্গলবারও সারা দেশে হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কেরানীগঞ্জে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

শেরপুরে বিএনপির প্রার্থীর ডা. সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকার ওপর হামলা করা হয়েছে। আত্মরক্ষার্থে তিনি রিটার্নিং অফিসারের অফিসে আশ্রয় নেন। সাতক্ষীরা, চাঁদপুরসহ কয়েক আসনে বিএনপির প্রার্থীদের অবরুদ্ধ করে রাখে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দেশে নির্বাচনী পরিবেশ মোটেও ভালো নয়। এখন পর্যন্ত নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়নি, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নির্বাচনে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আর এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের নির্ভয়ে ও অবাধে প্রচার করার অধিকার রক্ষা করা নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

কিন্ত এখন পর্যন্ত তারা সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি। কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি এবার প্রার্থীদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমকর্মীরাও হামলার শিকার হচ্ছেন, যা কখনও দেখা যায়নি।

মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন এসব দৃশ্য দেখে মজা পাচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

তিনি বলেন, এখনও সময় আছে গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীনদের সহনশীল হতে হবে। তাদের মারমুখী অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। যদি তা না করে হামলা-মামলা অব্যাহত রাখে তবে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা বলা যাচ্ছে না।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version