এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মে মাস, মুষলধারে বৃষ্টির এক রাত। সে রাতে কক্সবাজারের কুতুপালং শরনার্থী শিবিরের প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রহিমা নামের রোহিঙ্গা এক নারী। তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন আরেক রোহিঙ্গা নারী দিলদার বেগম। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় রহিমার। মৃত্যুর আগে সে জন্ম দেয় ফুটফুটে এক কন্যা শিশুর। সদ্য জন্মানো শিশুটির আপন বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। পাশে রয়েছেন শুধু দিলদার বেগম, যার সাথে তার নেই কোনো রক্তের সম্পর্ক।

নাড়ি কাটার সময় দিলদার বেগম ভাবতে থাকেন, হয়ত এটা আল্লাহরই ইচ্ছা যে তিনিই শিশুটির দেখাশুনা করেন। সে রাতে পঞ্চাশ বছর বয়সী দিলদার আবারো নতুন করে মা হন। এরই সঙ্গে তার জীবনে নতুন আরেক এক সংগ্রামেরও সূচনা হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে নিজ দেশ থেকে বিতারিত হয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে সংগ্রামময় জীবন চলছে তার। এর মধ্যে আবার সদ্যোজাত শিশুটির জীবনের চিন্তা। কাছে কোনো অর্থ নেই, নেই স্তনপান করানোর সক্ষমতা। এ অবস্থায় শিশুটির খাবারের ব্যবস্থা করা তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এসব কথা দ্যা গার্ডিয়ানকে জানান দিলদার বেগম নিজেই।
দিলদার বেগম স্মরণ করতে থাকেন এক বছর আগের দিনগুলোর কথা। আগস্ট মাসে রাখাইনে তাদের গ্রাম বুথিডংয়ে হামলা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। পরিবারসহ পালিয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন দিলদার বেগমের পুরো পরিবার। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি আসার পর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এক তরুণ দম্পি অর্থাৎ রহিমা ও তার স্বামী। রহিমা তখন কয়েক মাসের সন্তানসম্ভবা। পথিমধ্যে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে সেনাবাহিনী। পরিস্থিতির শিকার রহিমা সেখানেই স্বামীর মৃতদেহ ফেলে আসতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে এসে রহিমাকে নিজেদের সঙ্গেই একই আশ্রয়কেন্দ্রে রাখেন দিলদার বেগম। এর কয়েকমাস পরেই সন্তান জন্মদানের সময় মারা যায় রহিমা। এখন ছোট্ট রহিমাকে ভরণ পোষণ করাই যেন দিলদার বেগেমের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সেটি তার জন্য খুবই কষ্টের। প্রথম দিকে শিশুটিকে স্তনপান করানোর জন্য দিলদার বেগম তার দুই মেয়েকে অনুরোধ করেন। কিন্তু শিশুটি তাদের বুকের দুধ গ্রহণ করে নি। আর তার জন্য বিকল্প কিছু ব্যবস্থা করাও দিলদার বেগমের জন্য সম্ভব ছিল। সেজন্য কলা, চালের গুড়া এবং পানি মিশিয়ে শিশুকে খাওয়াতে শুরু করেন তিনি। দিলদার বেগম জানান, এতে সম্ভবত শিশুটির পেট ভরে না, মাঝেমধ্যেই কান্নাকাটি করে সে। এ চিত্র শুধু একা দিলদার বেগমের ঘরেরই নয়, ঘটেছে আরো অনেক রোহিঙ্গা পরিবারে। গত এক বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে পরিত্যাক্ত সদ্যোজাত শিশুদের সংখ্যা লক্ষ্যনীয়ভাবে বেড়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়েরা এসব বেশিরভাগ শিশুর জন্ম দিয়েছে। সঙ্গে রয়েছে এতিম ও মা-বাবার থেকে বচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুও। সেভ দ্যা চিলড্রেন এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় ৪৮ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই শিবিরে জন্মেছে ও তাদের নাম নিবন্ধিত হয়নি। আর রোহিঙ্গারাও এ বিষয়গুলো নিয়ে নীরব থাকছে। কেননা ধর্ষণের শিকার হয়ে শিশুর জন্ম দেয়া তাদের রক্ষণশীল সমাজে লজ্জার। এ বিষয়ে সায়েদা খাতুন নামের রোহিঙ্গা শিবিরের এক ধাত্রী জানান, অনেক পরিবারেই এ ঘটনা ঘটেছে। অনেক নারী গর্ভপাত করার জন্য সে সময় ওষুধ খেয়েছে। তবে বেশিরভাগ মানুষই এ বিষয়ে একে অন্যের সঙ্গেও কখনও আলোচনা করে না।
তবে এসব শিশুর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এমনটাই জানিয়েছেন ড্যাফনি কুক, কক্সবাজারের সেভ দ্যা চিলড্রেনের একজন মুখপাত্র। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের প্রথা ভেঙে এসব শিশুদের প্রতি সাহায্যার্থে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অনেক পরিবার, প্রতিবেশি এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরিচিতরাও পরিত্যাক্ত ও এতিম শিশুদের দত্তক নিচ্ছেন। এসব শিশুদের গ্রহণের বিষয়ে তারা বেশ উদার।
সখিনা বেগম নামের একজন বিধবা নারীও একটি শিশুকে লালন-পালন করছেন। তিনি জানান, আমার পাঁচটি মেয়ে আছে। আমি সবসময়ই একটি ছেলে আশা করতাম। গতবছর বাংলাদেশী শিবিরে আসার পর একটি বাড়ির বাইরে রক্তমাখা শিশু পড়ে থাকতে দেখি। শিশুটিকে দেখার কেউ ছিল না। আমি তাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াই। আমার নিজের মেয়েটি তার থেকে ছয় মাসের বড়, কিন্তু তারপরও আমি তাকে বেশি দুধ খাওয়াই। সে আমার ছেলে। সে আমার কাছে আল্লাহর আশীর্বাদ। আর এভাবেই দিলদার বেগম আর সখিনার মতো পালক মায়ের যত্নে রোহিঙ্গা শিবরে বেড়ে উঠছে হাজার হাজার শিশু।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version