এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৯৮৮ সাল। মৃত্যুশয্যায় থাকা মাকে দেখতে মিয়ানমারে ফেরেন অক্সফোর্ডপড়ুয়া অং সান সু চি। দেশে তখন জান্তার স্বৈরশাসন। দেশে ফিরে তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ইয়াঙ্গুনের এক প্যাগোডার সামনে জমায়েত হওয়া সমাবেশে তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে যা হচ্ছে, আমি আমার বাবার মেয়ে হয়ে তা দেখার পরও চুপ করে থাকতে পারি না।’ বাবা মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক জেনারেল অং সান। বাবার প্রতি দেশবাসীর যে শ্রদ্ধা, তার ওপর ভর করেই শুরু হয় সু চি’র রাজনৈতিক জীবন। রুখে দাঁড়ান স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। সোচ্চার হন জনগণের মৌলিক অধিকার, জনগণের শাসন আর গণমাধ্যম ও মানুষের বাকস্বাধীনতার পক্ষে। জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে শিকার হয়েছেন অপার লাঞ্ছণা-বঞ্চনার। একটানা এক যুগের বেশি সময় বরণ করেছেন গৃহবন্দিত্ব। ফলে ‘গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুধু নিজ দেশবাসীর কাছেই নয়, সারা বিশ্বেই। স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তিতে নোবেলসহ পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা-পুরস্কার। পূজিত হয়েছেন ‘গণতন্ত্রের দেবী’ হিসেবে। আজ তিনি আর গৃহবন্দি নন। মিয়ানমার সরকারের স্টেট কাউন্সেলর তিনি। কিন্তু এখন সু চি আর সেই সু চি নেই। হয়ে উঠেছেন এক রক্তচোষা ডাইনি। গণতন্ত্রের সেই ‘চ্যাম্পিয়নই’ আজ হয়ে উঠেছেন বড় স্বৈরশাসক। কয়েক দশকের সামরিক শাসনের পর ২০১৫ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন সু চি। প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখবেন। কিন্তু গত তিন বছরেও নিজেদের সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেনি তার সরকার। বরং আরও স্বৈরাচারী শাসন চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর। এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ধিকৃত ও তিরস্কৃত ব্যক্তি হচ্ছেন সু চি। একসময় যারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন তারাই তার সবচেয়ে বড় সমালোচক। তার একটি কথাতেই যারা জীবনও দিতে প্রস্তুত ছিলেন, এখন তার কথা শুনলেই ক্ষেপে যান। কারণ তার ক্ষমতালোভী মুখোশ সবার সামনে উন্মোচন হয়ে পড়েছে।

একসময় যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, ক্ষমতার লোভে সেই বাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন সু চি। তার সময়েই রাখাইন রাজ্যে যেভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যার রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কাচিন জাতির ওপর চলছে সমান নির্যাতন। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন তিনি। কেউ কেউ বলছেন, সু চি এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। যেন তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটি কেড়ে নেয়া হয়। ছবি ও কার্টুনে তাকে ব্যঙ্গ রাক্ষসী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা, তা প্রমাণ করে তিনি এক রক্তচোষা ডাইনি। ২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পূর্বে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রধানত মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করত। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত-নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করে। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। অস্বীকার করা হয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারসহ তাদের সব মৌলিক অধিকার। মিয়ানমার সরকার তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী দাবি করছে। রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সামরিক অভিযান ও অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয়।

গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুরু করে পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ অভিযান। তাদের যোগ দেয় সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ অধিবাসীরা। নারীদের হত্যা ও ধর্ষণ, বাচ্চাদের আগুনে নিক্ষেপ ও জবাই করে হত্যা। এভাবে ১০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা হত্যা করে, অভিযান থেকে বাঁচতে ৭ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version