এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টি সরকারে থাকবে না বিরোধী দলে? এ প্রশ্ন নির্বাচনের পর থেকেই চলছে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার দলের কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে সংসদীয় দলের বৈঠক হয়। সংসদ ভবনের বিরোধীদলীয় নেতার অফিসের ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় জাপা সরকারে থাকার। ওই সভায় অবশ্য দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনুপস্থিত ছিলেন। একদিন পরই শুক্রবার এরশাদ সিদ্ধান্ত জানান জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকবে। শুধু তাই নয়, তিনি হবেন বিরোধীদলীয় নেতা।

পাশাপাশি উপ-নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন জিএম কাদেরকে। এ অবস্থায় জাপার অভ্যন্তরীণ কোন্দল ফের প্রকাশ্যে এসেছে।

এ অবস্থায় জাপার নব-নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাও বিব্রত। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জানান, সংসদে জাপা এবার পূর্ণাঙ্গ বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। কোনো মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবে না। তবে এরশাদ বৃহস্পতিবার জাপার এমপিদের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। ছিলেন না পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকেও। তার অনুপস্থিতিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে জাপা সরকারে থাকার সিদ্ধান্তের কথা জানান পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা।

রাঙ্গা ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, আমরা মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করেছি। তাই বেশির ভাগ এমপিই সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়। এ ব্যাপারে মহাজোটের নেত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। দশম সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রওশন এরশাদই থাকবেন নাকি নতুন কেউ হবেন সে বিষয়ে ওইদিন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি দলটির নবনির্বাচিত এমপিরা। দলের নীতিনির্ধারণী সভায় বিষয়টি সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ওইদিন এরশাদ ছাড়া জাপার নবনির্বাচিত ২১ জন এমপি শপথ নেন।

জাপার একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রওশন এরশাদের সভাপতিত্বে জাপার সংসদ সদস্যরা প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে জাপা সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। তবে, জাপা সরকারে থাকা না থাকা নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়। দশম সংসদের তিন মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মুজিবুল হক চুন্নু সুযোগ পেলে এবারও মন্ত্রী হতে চান। ওই বৈঠকে দশম সংসদে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা একজন বলেন, আমরা মন্ত্রিত্বে থাকতে চাই, মন্ত্রিত্ব ছাড়তে চাই না। একই ধরনের বক্তব্য রাখেন আরেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মহাজোটে আছি। সরকারেও থাকতে চাই, বিরোধী দলেও থাকতে চাই। এ দু’জনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান জানতে চান, আপনারা টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। জাপার জন্য আপনারা কী করেছেন? জাপার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, জাতীয় পার্টিকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন।

রওশন এরশাদের বক্তব্যের জবাবে ওই প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা জাপার জন্য অনেক কিছু করেছি। আরো কিছু করতে চাইলেও তা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আমরা এগুতে পারিনি। এ দুই মন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে ঢাকা থেকে নির্বাচিত এক এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, আপনারা একা একা মন্ত্রিত্বে থাকবেন কেন? দরকার হলে দলের সবাইকে মন্ত্রিপরিষদে নিয়ে নিন। এই বক্তব্যের পর তিনি তোপের মুখে পড়েন বৈঠকে মন্ত্রিত্বে থাকা তিন নেতার সঙ্গে তার উচ্চবাচ্য হয়। তবে দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান জাপাকে সংসদের বিরোধী দলে রাখার পক্ষে মত দেন। দুই কো-চেয়ারম্যানের এই অবস্থানের ফলে মিটিংয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ওই বৈঠকে জাপা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ জানান, আমাদের সংসদ নেতা ও উপনেতা কে হবে তা পরবর্তী বৈঠকে নির্ধারণ করা হবে। পরবর্তীতে ব্রিফিংয়ে একই কথা জানিয়েছিলেন জিএম কাদেরও। তিনি বলেছিলেন, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা কে হবেন, তা এখনো ঠিক হয়নি। আশা করি, পরবর্তী বৈঠকে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

গতকাল দুপুরে জাপা চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত ‘সকলের অবগতির জন্য’ শিরোনামে এক চিঠির মাধ্যমে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্টির সর্র্বস্তরের নেতা-কর্মী ও সমর্থক এবং দেশবাসীর উদ্দেশে আমি এই মর্মে জানাচ্ছি যে, একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। পদাধিকার বলে জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি দলের সভাপতি হিসেবে আমি প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং পার্টির কো-চেয়ারম্যান জনাব গোলাম মোহাম্মদ কাদের উপ-নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। জাতীয় পার্টির কোনো সংসদ সদস্য মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না। সংসদের মাননীয় স্পিকারকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি।’

এরশাদের এ সিদ্ধান্তের পর পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের গতকাল বিকেলে এরশাদের বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, দেশের বৃহত্তম স্বার্থে জাতীয় পার্টি এবার জাতীয় সংসদে প্রধানবিরোধী দলের ভূমিকায় আসছে। আমি যেটুকু জানি, জাপা চেয়ারম্যান মহাজোটের সঙ্গে আলোচনা করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, বৃহস্পতিবার বৈঠকের শেষ পর্যায়ে একটি সিদ্ধান্ত ছিল আমরা সরকারের সঙ্গে থাকতে চাই, তবে জোট কিংবা দেশের স্বার্থে যদি কোনো সিদ্ধান্ত হয় তা মেনে নিবো।

পার্টির সংসদ সদস্যদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এরশাদ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছেন সাংবাদিকরা জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, গতকাল যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমরা মহাজোটের সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু পরে আমাদের চেয়ারম্যান মহাজোটের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন। আমাদের চেয়ারম্যান তাতে রাজি হয়েছেন।

জিএম কাদের বলেন, মহাজোট সরকারের বাইরে এসে কাজ করতে হবে, চেষ্টা করবো আমরা। সমস্যা কিছু তো আছেই। সেটা তো আমরা কালকে তুলে ধরেছি। যেকোনো কারণেই হোক, এখন মহাজোটেই এই সিদ্ধান্তটি হয়েছে। আমরা ধরে নিচ্ছি, এটাতে সামনে আমাদের ভালো হবে।

দলের সব সংসদ সদস্যরা যখন মহাজোট সরকারের অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছিলেন, তখন এরশাদের এই সিদ্ধান্তে দলে কোন্দলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিয়েছেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, দলের ভেতরে কোন্দলের প্রশ্নই আসে না। বৃহত্তর স্বার্থে চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জোটের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। তো সে হিসেবে আমি মনে করি যে দলে কোন্দলের কোনো স্কোপ আর নেই। এরশাদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে বৃহস্পতিবার শপথ নিতে না পারলেও রোববার অথবা সোমবার এরশাদ শপথ নিতে পারেন বলে জানিয়েছেন জিএম কাদের। তিনি বলেন, তার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। তিনি আজকালের মধ্যে চেকআপ করাবেন একবার। তারপর শপথ নেবেন।

পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দশম সংসদের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু মানবজমিনকে বলেন, স্যার আমাদের কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি এবং মিটিংও করেননি। স্যার যেহেতু চেয়ারম্যান তাই তার স্টেটমেন্টের উপর কোনো মন্তব্য নেই। তিনি নিজেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে জাপার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বলেছি, মন্ত্রিপরিষদে থাকতে চাই, তবে কে কে থাকবেন তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। এছাড়া স্যারের সঙ্গে কোনো বৈঠক হওয়ার কথাও ছিল না। এছাড়া তার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগই হয়নি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version